মালদা জেলার ইংরেজবাজারে এমন এক প্রাচীন কালীমন্দির আছে যার পুজোর রীতি এমনকি দেবী মূর্তিও বাকি চিরাচরিত কালী মন্দিরের থেকে এক্কেবারে আলাদা। আজ সেই গল্পই হোক। মন্দিরের নাম জহরা কালীমন্দির। তবে এখানে দেবী চণ্ডী পূজিতা হন। সারা বছর এখানে পুজো চললেও বৈশাখ মাসের শনিবার ও মঙ্গলবার থাকে বিশেষ পুজোর আয়োজন। তখন ভক্ত সমাগম খানিক বেশি হয়। বৈশাখ মাসে এই মন্দিরে আকর্ষণের অন্যতম কারণ হলো বিশাল মেলা। এবার বলি সেই বিশেষত্বের কথা। অন্যান্য কালীমন্দিরে যেমন রাত্রিবেলা পুজো হয় এখানে তা নয়। শাক্ত মতে, মা কালী প্রকট হন ‘মধ্য যামে’ অর্থাৎ মাঝ রাতে। কিন্তু এই মন্দিরে সব পুজোই হয় দিনের আলো থাকাকালীন। আর সপ্তাহে মাত্র দু -দিন কেবলমাত্র শনি আর মঙ্গলবারেই হয় দেবীর আরাধনা ।
কিন্তু এই জহরা কালীর পুজোর সূচনা হলো কি করে ? যথারীতি নানা মতের অবতারণা হয়েছে -সাথে আছে বিশ্বাস। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সেন রাজা বল্লাল সেন এই অঞ্চলে অনেকগুলি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে একটি হল এই মন্দির। আবার মন্দিরের গায়ে যে পাথরের ফলক আছে, তা থেকে অনুমান করা যায়, মোটামুটি ৩০০ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের এক সাধক স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে দেবী জহরা চণ্ডীর বেদি স্থাপন করেছিলেন। কথিত আছে পরবর্তীকালে হীরারাম তিওয়ারি নামের এক সাধক দেবীর রূপ প্রত্যক্ষ ও করেছিলেন। আর সেই রূপই দেবীর প্রতিষ্টিত এখানে। দেবীর এই রূপ কিন্তু প্রচলিত মূর্তিগুলির মতো নয়। লাল রঙের ঢিবির ওপর রয়েছে এক মুখোশ। ঢিবির দু’পাশে আরও দু’টি মুখোশ দেখা যায়। এছাড়া গর্ভগৃহে আছে শিব আর গণেশের মূর্তি। বৈশাখ মাসে দেবী জহরার পুজো এভাবেই প্রচলিত হয়। তিওয়ারিরাই বংশানুক্রমে এখনও দেবীর সেবায়েত।
এবার আসি দেবীর এই অদ্ভুত নামের ব্যাখ্যায়। স্থানীয় মতে, অনেক অনেক বছর আগে এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে পূর্ণ। খুব ঘন জঙ্গল ছিল এই অঞ্চলে। আর সেখানে ডাকাতদের প্রাদুর্ভাব কম ছিল না। আর এই দেবী ছিলেন ডাকাতদের আরাধ্যা। এখানে দেবী চণ্ডীর পুজো করে ডাকাতরা লুন্ঠিত প্রচুর ধনরত্ন এনে মাটির তলায় রাখত। আর তার ওপরই দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধনরত্নকে হিন্দিতে বলে ‘জওহর’। দেবীমূর্তির নিচে প্রচুর ধনরত্ন রাখা থাকত বলেই এখানে দেবী চণ্ডী ‘জহরা’ বা ‘জহুরা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। অবশ্য স্থানীয় অনেকের মতে বহু আগে দেবী জহরার পূর্ণাবয়ব বিগ্রহ ছিল এখানে। কিন্তু বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পুরোহিতরা সেই মূর্তিকে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে নাম নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও এই দেবী যে বাকিদের থেকে খানিক ভিন্ন এবং তার পুজোর রীতিও যে ভিন্ন তাতে সন্দেহ নেই। তবে ভিন্নতা সত্ত্বেও তিনি আজ স্ব- মহিমায় পূজিতা হচ্ছেন।