মা দুর্গার এই ভোগ হয় নুন ছাড়া!

 কলকাতার বনেদি বাড়ীগুলোর এক বিশেষ ঐতিহ্য হলো তাদের দুর্গা পুজো। যারা বয়েসে বেশ প্রবীণ। আর এই বিত্তবান সাবেকী পুজোর তালিকায় আজও অগ্রাধিকার পায় জানবাজারের রানী মা অর্থাৎ রানী রাসমণির বাড়ীর দুর্গা পুজো।  সম্প্রতি বাংলা টেলিভিশনের দৌলতে রানী রাসমণি স্বপরিবারে বেশ জনপ্রিয় হলেও আজ এমন এক বিশেষ তথ্য জানাবো, হলফ করে বলতে পারি এ সম্পর্কে বড় একটা আলোকপাত হয় না।

জানবাজারের বাড়ীতে দুর্গা পুজোর সূচনা করেন রানী রাসমণির শ্বশুরমশাই প্রীতরাম দাস(মাড়), সেই থেকেই এ বাড়ীতে পূজিতা হন একচালা শোলার সাজের মহিষাসুরমর্দিনী। আর এইখানেই আছে বিশেষত্ব, আজও সেই ধারা অটুট আছে এবং বংশ পরম্পরায় সেই শিল্পী ও কারিগরদের পরিবার এই প্রতিমা নির্মাণ করেন। রথের দিন কাঠামো পুজো দিয়ে সূচনা হয় উৎসবের। প্রতিমা শিল্পীরা আসেন বীরভূমের আমোদপুরের কুসুমযাত্রা গ্রাম থেকে। এই প্রতিমার বিশেষত্ব হলো এই মূর্তি কোনও ছাঁচে তৈরি হয় না। শিল্পীর হাতের জাদুতে, দক্ষতায় মা দূর্গা স্ব-পরিবারে মূর্ত হন। একচালার চালচিত্রের উপর বর্ধমানের শোলা শিল্পীরা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন আজও। এখানে দেবী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা, আর একটু ব্যাখ্যা করলে শিউলি ফুলের বোঁটার রং বললেও অত্যুক্তি হয় না।

rani

 এ পুজোর  জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় স্বামী রাজচন্দ্র দাসের (মাড়)  মৃত্যুর পর রানী রাসমণি পুজোর দায়িত্ব নিলে। ১৮৬১ সালে রানীর মৃত্যুর পর এই পুজো তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়। রাসমণির চার কন্যার বংশধরেরা এখন থাকেন তিনশো ঘর সমন্বিত এই যানবাজার রাজবাড়ীতে। মথুরামোহন ও জগদম্বার পৌত্র ব্রজগোপালের কন্যা লাবণ্যলতার বিবাহ হয় বিজয়কৃষ্ণ হাজরার সাথে। এই হাজরা পরিবার বর্তমানে যেখানে থাকেন সেখানে আদি দুর্গামণ্ডপ। অন্য অংশে বাস বড় মেয়ে পদ্মমণি ও রামচন্দ্রের বংশধরদের। যদিও সেখানে পুজো হয় না। অন্য অংশে থাকেন মেজো মেয়ে কুমারী ও প্যারীমোহন চৌধুরীর বংশধরেরা। এই অংশে ঠাকুর দালানে হয় এখনকার দুর্গাপুজো, যা চৌধুরীদের পুজো নামেই খ্যাত। এই দালানেই আজও রানীর এক বিশাল চিত্র আছে।

 রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেই আছে মথুরামোহন নির্মিত রাসমণি ভবন। এখানেও সাবেকি প্রথায় তবে শাক্ত মতে বলি প্রথার মাধ্যমে দুর্গা পুজো সম্পন্ন হয় আজও, তা বিশ্বাস বাড়ির পুজো নামেই খ্যাত।

 যাই হোক,  রানী মায়ের বাড়ীর পুজোয় বিধি অনুযায়ী ষষ্ঠীর দিন হয় বোধন এবং বেল বরণ। ওই দিনই দেবীর হাতে অস্ত্র দিয়ে গয়না পরানো হয়। সপ্তমীর দিন গোপাল, লক্ষ্মী-জনার্দনকে আনা হয় ঠাকুর দালানে। এই পুজোর বিশেষ রীতি সপ্তমী, অষ্টমী,  নবমীর কুমারী পুজো। বাড়ীর মেয়েরা সেই আমল থেকেই অন্দরমহলের একটি বিশেষ সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করেন এই ক’দিন। পুজোর চারদিন মূল দরজা দিয়ে ঠাকুর দালানে আসা নিষেধ তাঁদের।

এবার আসি ভোগের বিষয়ে। এ পুজোর ভোগের রান্না হয় গঙ্গা জলে, পুজোয় অন্ন ভোগ হয় না, দেবীকে লুচি ও পাঁচ রকম ভাজা অর্পণ করা হয়, তবে অভিনব হলো সবই হয় নুন ছাড়া

শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোতে এতটুকুও ভাটা পড়েনি আভিজাত্য ও সাকেবিয়ানায়। বাড়ির সামনের বারান্দায় নাট মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপুজো। ঐতিহ্যবাহী এই পুজোয় কে হননি সামিল!  এই বাড়ীতে পা দিলেই টাইম মেশিনে মন এমনি চলে যাবে সেই সময়ে- যেখানে সাক্ষাৎ হয়ে যেতে পারে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ দেবের সাথে। এই সেই বাড়ী, ঐতিহ্য এতটুকু ম্লান হয় না, তা সে যতই ভাগ হোক না কেন। আজ সেই একই ভাবে মা মূর্ত হন স্ব-পরিবারে, স্ব-মহিমায়, আজও হাল ফ্যাশনের অত্যাধুনিক কলকাতা সম্মান জানায় তাকে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...