সন্ধ্যের কলকাতা, মাঝ গঙ্গার ওপর ভেসে যাচ্ছে একটা নৌকো, সওয়ারি মাত্র দুজন, শর্মিলা ঠাকুর আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর গেয়ে চলেছেন বিষন্ন সংগীত, 'যখন ভাঙলো মিলনমেলা ভাঙ্গল'............. একটু কি চেনা লাগছে দৃশ্যটা ? সৌমিত্র শর্মিলা অভিনীত“বর্ণালী” ছবিটি বাংলার বেসিক সিনেমার একটি সম্পদ, আর এই ছবিতেই শর্মিলা ঠাকুরের ঠোঁটে রুমা গুহঠাকুরতার কণ্ঠে 'ভাঙলো মিলনমেলা' রবীন্দ্রসংগীতটি এককথায় অনবদ্য, গানটিকে এমন ভাবে গেয়েছিলেন রুমাদেবী যে একবারও মনে হয়নি এটির আলাদা কোনো অস্তিত্ব আছে, চরিত্রের সঙ্গে এবং চিত্রনাট্যের সঙ্গে এমন ভাবেই মিশে গিয়েছিলো সে গান।
রুমাদেবীর ছায়াছবির জগতে পথ চলা শুরু ১৯৪৪ সালে “জোয়ার ভাঁটা” সিনেমার মধ্যে দিয়ে, গানের জগতে প্রবেশ তারও অনেক আগে। ১৯৩৪ সালে কলকাতায় সত্যেন ঘোষ ও সতী দেবীর ঘরে জন্মান রুমা, মা সতী ঘোষ ছিলেন সেই যুগের অন্যতম প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী এবং প্রথম মহিলা সংগীত পরিচালক। মায়ের কাছেই সংগীত শিক্ষা শুরু তারপর সান্নিধ্য পেয়েছেন অনেক খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞদের, গান শেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাসের কাছ থেকেও। ১৯৫১ সালে আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কিশোর কুমারের সাথে বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আগেই অভিনয় করে ফেলেছেন তিনটি হিন্দি ছায়াছবিতে, তারমধ্যে নীতীন বসু পরিচালিত "মশাল" অন্যতম।
১৯৫৮ সালে রুমা গুহঠাকুরতা তৈরি করেন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার। সলিল চৌধুরীর পর রুমাদেবী আর তার ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারই বাঁচিয়ে রাখে ভারতীয় কয়্যার সংগীত এর ঐতিহ্য।কয়্যার সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর প্রেমের কারণও ছিল, খুব ছোট থেকেই তিনি ওতপ্রোত ভাবে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তার কণ্ঠে “বিস্তীর্ণ দু’ পারে”বা “ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম” গান দুটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।কয়্যার সংগীত ছাড়াও ফিল্মি গান বিশেষত রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিশেষ দখল ছিল রুমাদেবীর, তিনি যে কয়টি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিলেন তার প্রত্যেকটিই শ্রোতাদের কাছে বিশেষ সমাদৃত ছিল, বাংলা সিনেমার জন্যেও রুমা গুহঠাকুরতা বেশ কয়টি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিলেন, "মনিহারা" ছবিতে "বাজে করুণ সুরে" এবং পূর্বোক্ত "বর্ণালী" সিনেমার 'যখন ভাঙলো মিলনমেলা" এবং তপন সিংহ পরিচালিত "নির্জন সৈকতে" ছবির "শুকতারা আঁখি মেলে চায়", "লুকোচুরি" ছবিতে কিশোর কুমারের সাথে "মায়াবন বিহারিণী” অথবা "বাক্স বাদল" সিনেমায় ব্যবহৃত "মায়ার খেলা" গীতিনাট্যের গানগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
বাংলা ছবিতে রুমা গুহঠাকুরতার পথ চলা শুরু ১৯৫৯ সালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে "পারসোনাল এসিস্টেন্ট" ছায়াছবির মধ্যে দিয়ে, তারপর রাজেন তরফদারের গঙ্গায় রুমাদেবীর অভিনয় বিশেষ প্রশংসিত হয়| একমাত্র ঋত্বিক ঘটক ছাড়া সেই যুগের প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা পরিচালকদের সঙ্গেই চুটিয়ে কাজ করেছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় "অভিযান" এবং অরূপ গুহ ঠাকুরতার পরিচালনায় "বেনারসি" ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয় দর্শক আজও মনে রেখেছেন। আবার তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় "পলাতক" ছবিটিতে ময়না চরিত্রে তাঁর অভিনয় অনেকের মনে দাগ কেটে যায়, একই কথা বলা যায় তপন সিংহের্ পরিচালনায় "নির্জন সৈকতে" ছবিটিতে রুমাদেবী অভিনীত চরিত্রের ক্ষেত্রেও, দুটি চরিত্রের ক্ষেত্রেই রুমাদেবী ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে কিন্তু তার ব্যক্তিগত দক্ষতাতেই চরিত্র দুটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন, এছাড়া "এন্টনি ফিরিঙ্গি", "বালিকা বধূ", "জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার", "যদি জানতেম", "দাদার কীর্তি", "ভালোবাসা ভালোবাসা" সিনেমা গুলিতে তাঁর অভিনয় দর্শকদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। বাংলা সিনেমার প্লে ব্যাক সিঙ্গার হিসেবেও তিনি গভীর ছাপ রেখে গিয়েছেন, "লুকোচুরি" আর "পলাতক" ছবিদুটিতে তার গাওয়া গানগুলি আজ শ্রোতারা মনে রেখেছেন, "লুকোচুরি" ছবিতে "মায়াবন বিহারিণী" গানটি ছাড়াও "এইতো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়" গানটিও রুমাদেবী কিশোরকুমারের সাথে গেয়েছিলেন, আর "পলাতক" ছবিটিতে গীতা দত্তের সাথে "মন যে আমার কেমন কেমন করে", আর "চিনিতে পারিনি বঁধু" গান দুটি শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। এই মাসেরই ৩ তারিখে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন রুমা গুহা ঠাকুরতা, রেখে গিয়েছেন তাঁর সৃষ্টি তাঁর অবদান, এভাবেই তিনি চিরকাল তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই আমাদের মাঝে রয়ে যাবেন।