কতকাল দেখিনি তোমায়
একবার তোমায় দেখি
বড়ো সাধ জাগে...
না না, এখানে কোনো প্রেমিক প্রেমিকা বা প্রিয়তম মানুষের কথা বলি নি। কী বললেন? স্বর্ণকন্ঠী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কালজয়ী গান নিয়ে ইয়ার্কি করা উচিৎ নয়? আরে না মশাই, সে দুঃসাহস আমার নেই। আসলে বেশ কয়েকমাস ঘরবন্দী হয়ে থাকার পর যখন আপনার প্রাণটা বাইরে বেরোনোর জন্য আকুলি বিকুলি করবে ,বাইরের পৃথিবীটা দেখার জন্য আপনি অস্থির হয়ে পড়বেন, তখন এই অসামান্য গানটি আপনার মনে পড়বেই। একদিন আপনি এই গানটা গুনগুন করে গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়বেনই... বাড়ির বাইরের দুনিয়াটাকে দেখার জন্য। হ্যাঁ, অবশ্যই যথোপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেই। কিন্তু এই মুহূর্তে তো খুব বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে বরং চলুন মোটামুটিভাবে কাছাকাছি মুর্শিদাবাদ। তবে মুর্শিদাবাদ বলতেই যে জায়গাটার কথা মনে পড়ে সেই হাজারদুয়ারীর কথা আমি বলছি না। এখানে আমি বলতে চলেছি মুর্শিদাবাদ জেলার এমন একটা জায়গার কথা যেটা ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে এখনো খুব বেশি পরিচিত নয়। অথচ দেখার মতো কতো কিছুই না ছড়িয়ে আছে এই গঞ্জ শহরটিতে। জায়গাটা হলো আজিমগঞ্জ। মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে মোটামুটি তেরো চৌদ্দ কিলোমিটার রাস্তা। কলকাতা থেকে গাড়িতে কমবেশি সাতঘন্টা লাগবে। একটা দিন যদি হাতে নিয়ে আসেন তাহলে মনের আনন্দে ঘুরতে পারবেন।
ভাগীরথী তীরে অবস্থিত এই শহরটা দেখলে আপনার অনেকটা কাশীধাম বা বারাণসীর কথা মনে পড়বে। নবাবী আমলের তিনশো বছরের ও বেশি পুরনো এই শহরে সেইসময়ের বেশ কিছু বাড়িঘর এখনও রয়ে গিয়েছে। ছাদে কড়িবর্গা, বড়ো বড়ো জানালায় লোহার গরাদ, দরজার উপরে গোল করে দেওয়া রঙিন কাঁচ, পাতলা ছোট ছোট ইট চুন সুরকি দিয়ে গাঁথা দেওয়াল, দেওয়ালে কুলুঙ্গি, সরু সরু গলি এসবই আপনার মনকে কোন সুদূর অতীতে নিয়ে যাবে! এবার ভিতর দিকে এগিয়ে চলুন। মিনিট দশেক পরই বড়নগর নামে একটি জায়গায় পৌঁছে গেলেন। একেবারে ভাগীরথীর কোল ঘেঁষে যাচ্ছেন আপনি। এসে গেছে চার বাংলার মন্দির। নাটোরের রানী ভবানীর প্রতিষ্ঠিত আড়াইশো বছরের ও বেশি পুরনো মুখোমুখি চারটি শিবমন্দির। একই রকম দেখতে কিন্তু প্রত্যেকটা মন্দিরের গায়ে আলাদা আলাদা অপূর্ব টেরাকোটার কাজ। মন্দিরগুলি বন্ধই থাকে। রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে পুণ্যতোয়া গঙ্গা। এখানে ভাগীরথীর দুটো বাঁক আছে। ছোট ছোট নৌকা মাঝিরা বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে... তার যে অপরূপ সৌন্দর্য... শুধু নদীর দিকে তাকিয়েই আপনার সারাদিন কেটে যাবে। সত্যি সত্যিই এখানে এসে আপনার কবিগুরুর সেই কবিতাটি মনে পড়বেই...দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া....
এবার ঐ রাস্তা ধরেই হেঁটে একটু এগিয়ে যান। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই দেখতে পাবেন আরেকটি পুরাতাত্ত্বিক স্থাপত্যের নিদর্শন ভবানীশ্বর মন্দির। এই শিব মন্দির ও আনুমানিক ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে রানী ভবানীই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরের স্থাপত্যের বিশেষত্ব হলো এটি আটটি কোনযুক্ত এবং আটটি বারান্দা বিশিষ্ট। উপরের চূড়াটি মসজিদের গম্বুজের মতো আকৃতির। আর একটু এগোলেই ওরকম আড়াইশো বা তিনশো বছরের পুরনো আরো তিনটি মন্দির। দুটো মন্দিরে কোনো মূর্তি নেই। কিন্তু তার পাশেই আছে দুর্গা মন্দির। মা দুর্গা এখানে রাজরাজেশ্বরী রূপে প্রতিষ্ঠিতা। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে বসেছিল কিন্তু সম্প্রতি তার সংস্কার করা হয়েছে। অষ্টধাতুর তৈরি বেনারসী শাড়ি পরিহিতা অপূর্ব সুন্দর দুর্গা মূর্তি দেখলে আপনার চোখ এবং মন দুটোই জুড়িয়ে যাবে। মা রাজরাজেশ্বরী ছাড়াও আরো দুটি সালংকারা অপরূপ দেবীমূর্তি রয়েছে। প্রত্যেকবছর অন্নপূর্ণা পুজোর সময় এখানে বিরাট মেলা বসে। বেশ কয়েকদিন ধরে নানান অনুষ্ঠান হয়। আশেপাশের গ্ৰামগঞ্জ তো বটেই, বহু দূরদূরান্ত থেকেও বহু মানুষ আসেন এই মেলায়। এই মন্দিরেরই একপাশে মদনমোহন মূর্তি আছে। তিনি এবং দেবাদিদেব মহাদেব ও প্রতিদিন পূজিত হন। হ্যাঁ, এখানকার অন্যান্য মন্দিরগুলির মতোই মা রাজরাজেশ্বরী মন্দির ও রানী ভবানীরই প্রতিষ্ঠিত।
অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে এবার খিদে পেয়ে গেছে তো? কোনো চিন্তা নেই। আজিমগঞ্জের চমচম, সিঙ্গারা বা ক্ষীরকদম বিখ্যাত। একদিন নাহয় একটু আধটু অনিয়ম করলেনই.. আর গরমকালে গেলে তো মুর্শিদাবাদ জেলার সবথেকে বিখ্যাত ফলটি অর্থাৎ আম আপনাকে খেতেই হবে এবং বেশ কয়েক কেজি সঙ্গে করে নিয়ে ও আসতে হবে।
এবার ফেরার পালা। যেদিন যাবেন সেই দিনই যদি ফিরে আসতে চান ফিরে ও আসতে পারেন তবে একটা দিন হাতে নিয়ে যাওয়াই ভালো। বহরমপুরে অজস্র হোটেল আছে। নিজের সুবিধা মতো একটা হোটেলে একরাত থেকে, পরদিন মনের সুখে মুর্শিদাবাদি সিল্ক শাড়ি কিনে আর বিখ্যাত ছানাবড়া পেটপুরে খেয়ে "সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি" গাইতে গাইতে কলকাতার দিকে রওনা দিন।
আমাদের এই বাংলায় কতো যে এমন মণিমুক্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! চলুন না, একটু খুঁজে খুঁজে তাদের বের করে ফেলি!! উঠোন পেরিয়ে দুই পা ফেললেই.... আলিবাবার গুহা.. চিচিং ফাঁক..