গোটা বিশ্বে ঝড় হয়ে দাপিয়ে বেরিয়েছিল এক তরুণীর দিনলিপি।সময়টা গত শতকের চার এর দশক। এক ক্ষমতালোভী উন্মাদের স্বৈরাচারীতায় জর্জরিত সমগ্র ইওরোপ। বিশেষত জার্মানি। দেশে দেশে তখন মহাযুদ্ধের শঙ্খ নিনাদ বেজে চলেছে।
নাৎসি অধিকৃত জার্মানির এক ইহুদি পরিবারের বছর তেরোর এক কিশোরী। চোখে পৃথিবীকে আগলে রাখার স্বপ্ন।টুকটুকে ঠোঁটের হাসিতে মন মাতানো সুরধ্বনি। বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার এক ফ্রেমে সে বেমানান।তিনি অ্যান ফ্র্যাঙ্ক। আকাশ ঘন মেঘের মাঝেও এক চিলতে রোদ্দুর। ’৪২-এর ১২ জুন। কিশোরী তেরোর কোঠায়। আগেরদিন বাবার সঙ্গে গিয়ে দোকানে পছন্দ করে এসেছে লাল সাদা চেকের একটা ডায়রি।জন্মদিনেই স্বপ্ন পূরণ। বাবার দৌলতে হাতে পেয়েছে সেই বিস্ময় উপহার। বাইরে তখন অন্য কোনও কিশোরীর মরদেহ আগলে মায়ের বাঁধ ভাঙা চিৎকার...
বাইরে ক্ষমতার সেই ভয়ঙ্কর উচ্ছাসের আঁচ কি সত্যিই এসে পড়েনি কিশোরীর হাসিতে! নিশ্চয়ই ব্যকুল হয়েছে তার মন। আর সেই ভীষণ অসুন্দর কে প্রত্যাহার করার আকাঙ্খা থেকেই হয়ত কলম নেওয়া হাতে। জন্মদিনের ঠিক দুদিন পরেই লেখা শুরু। চলেছিল সপরিবারে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেরদিন পর্যন্ত। ডায়রি কে সম্বোধন করতেন প্রিয় কিটি নামে। এই কিটি হয়ত তাঁর আরও এক সত্তা। একদম ভিতরের কেউ। আসলে সময় কাটানোর জন্য কাওকে সেভাবে পেতেন না। ধর্মের কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাইরে বেরনোও নিষেধ।
সেসময় ঘটে চলা কোনও ঘটনাই কিন্তু বাদ পড়েনি কিশোরীর লেখনীতে। সবাই উঠে এসেছে; অন্য কোনও নামে বা ডাকে। অদ্ভুত সমকালীন সেসকল শব্দ। হাসির আড়ালে একদল কান্নারা উঁকি দিয়ে যায়।শুধুমাত্র তাই নয়, ছিল প্রথম রজস্বলা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে প্রথম চুম্বনের কথাও।
সরকারের তলব পড়লে ঠাঁই হয় একটা গোপন কুঠুরিতে। ডায়রি তখনও ছিল সঙ্গে। সেই তো একমাত্র স্বস্তিতে মাথা গোঁজার আপন কিছু। তবুও মৃত্যু পিছু ছাড়েনা কখনই। তার তলব কোনও বয়সের সীমারেখা বোঝেনা।গোপন আস্তানা আর গোপন থাকেনা। পুলিশ এসে সপরিবারে নিয়ে যায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। আরও কষ্ট, আরও যন্ত্রণা।
কেবল অটো ফ্রাঙ্ক বাদে সকলেরই একে একে মৃত্যু ঘটে। অ্যান দেহ ত্যাগ করেন যখন, তখন সে পনেরো । ঠিক কবে তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানা না গেলেও, অনেকেই ধারণা করেন যে ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসের দিকে বার্জেন-বেলসেনে টাইফাস নামক এক ধরণের জ্বড়ে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু।
অথচ তার মাত্র এক মাস বাদেই, এপ্রিলে ওই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সকল বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০১৫ সালে প্রকাশিত কিছু নতুন গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, অ্যান সম্ভবত ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।এর প্রায় এক বছর বাদে বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক তার পরিবারের সকলের মৃত্যুর সংবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত হন। সেই সময়েই তিনি তার মেয়ের ডায়েরিটি খুঁজে পান। তার হাতেই ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন বইটি নেদারল্যান্ডসে প্রকাশিত হয়।
নেদারল্যান্ডসে প্রকাশিত হওয়ার বছর তিনেক পর, ১৯৫০ সালে বইটির জার্মান ও ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশিত হয় দ্য ডায়েরি অফ এ ইয়ং গার্ল শিরোনামে।প্রথম মুদ্রণে ছাপা হয়েছিল বইটির পাঁচ হাজার কপি। দ্বিতীয় মুদ্রণে ১৫ হাজার কপি। আর তৃতীয় মুদ্রণে ৪৫ হাজার কপি। এভাবেই ক্রমেই বইটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং মাত্র কয়েক বছরের ভিতরই বইটির লক্ষাধিক কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ২০১৫ সালে অ্যান ফ্র্যাঙ্ক ফন্ডস এর রেকর্ড অনুযায়ী, বিশ্বের ৬০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি।
নেলসন ম্যান্ডেলা এই বইটি সম্পর্কে বলেছিলেন, রোবেন দ্বীপে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি পড়ত। বইটি একই সঙ্গে আমাদের উৎসাহ দিত, উদ্দীপনা জাগিয়ে রাখত, ঠিক একইভাবে আমাদের শক্তি জোগাত এটা বিশ্বাস করতে যে স্বাধীনতা আসবেই।প্রথমে আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া সাংবাদিক হব, তারপর আমি বিখ্যাত লেখক হতে চাই। যা-ই ঘটুক, যুদ্ধের পরে আমি দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স নামের বই প্রকাশ করতে চাই-
এই স্বপ্নই তো দেখেছিলেন তিনি, বাকি আর পাঁচজন মেয়ের মত। দ্বন্দ্ব থাকতে পারে তাঁর মৃত্যুর সঠিক দিন নিয়ে। তবুও স্বন্দ্ব থাকেনা তাঁর অকুতোভয় রোম্যান্টিসিস্ম্ নিয়ে।তিনি স্বরণে থাকেন রোজ। তিনি স্বরণে আসেন রোজ। সেই সমস্ত মানুষের যারা এখনও স্বপ্ন দেখতে ভোলেননি।