শান্ত, মিশুকে স্বভাব। চেহারায় আদুরে ভাবটা কাছে টানে যে কাউকে। কালো চোখে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। যে কোনও জিনিস শিখে নিতে পারত চট করে।
ডাক্তার ভ্লাদিমির ইয়াযদভস্কি একদিন ল্যাবরেটারি থেকে বাড়ি এনেছিলেন তাকে। তার স্বভাবের জন্যই বাড়ির ভ্লাদিমির ইয়াযদভস্কির বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে মিশে যেতে বেশি সময় নেয়নি সে।
ইয়াযদভস্কির পরিবারের ছোট্টখাট্টো চেহারার সেই সদস্যই পরে হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম ‘সেলিব্রিটি’ নাম। লাইকা। পৃথিবীর প্রথম মহাকাশযাত্রী। কিন্তু তার বেদনার কাহিনীটাও ভোলার নয়। যেমন ভুলতে পারেননি ডাক্তার ভ্লাদিমির ইয়াযদভস্কি।
সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির মেডিকেল ইউনিটের প্রধান ছিলেন তিনি। ‘লাইকা’কে নির্বাচন করা হয়েছিল তার বাধ্য প্রকৃতি আর ছোট চেহারা এবং হালকা ওজনের জন্য। হাস্কি এবং টেরিয়র- এর মিশ্র প্রজাতির ছিল বলে মনে করা হলেও আদ্যন্ত ‘রাস্তার কুকুর’ বলতে যা বোঝায়, লাইকা ছিল তাই।
মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার আগে লাইকাকে তার উপযুক্ত করে তোলা হয়েছিল। অস্ত্রপ্রচার করা হয় রক্তচাপ এবং হৃদ যন্ত্রের গতিবিধি জানার জন্য।
লাইকাকে নির্বাচনের পর প্রায় সকলেই আন্দাজ করেছিলেন সে আর কখনও জীবিত ফিরতে পারবে না। তাই তাকে বাড়িতেও আনা হয়।
মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার আগে লাইকাকে তার উপযুক্ত করে তোলার হয়েছিল অস্ত্রপ্রচার করা হয়। রক্তচাপ এবং হৃদ যন্ত্রের গতিবিধি জানার জন্য। ধমনীর সঙ্গে বসানো হয় একটি ট্রান্সমিটার। লাইকার জন্য বিশেষ ধরনে তৈরি খাবার দেওয়া হয়। জলের পরিবর্তে বিশেষ জেল। তবে খাবার এবং জল সবটাই টিউবে ভরা।
১৯৫৭। ৩ নভেম্বর। স্পুটনিক-২ পৃথিবীর কক্ষপথ চারবার প্রদক্ষিণ করার পরই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে স্পেসশিপের অভ্যন্তরে। শরীরের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রিতে ওঠার পর উত্তাপ আর সহ্য করতে পারেনি লাইকা। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গিয়েছিল তিনগুণ। কিছু সময় পরই দগ্ধ হয়ে মারা যায়।
ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম পরে ফ্লাইটে থাকাকালীন অবস্থায় লাইকার হৃদস্পন্দনের মাত্রা ঠিক কেমন ছিল তার ছবি প্রকাশ করে। কক্ষপথে পৌছাবার পর ১০৩ মিনিট লেগেছিল পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে।
স্পুটনিক ফিরে আসার পর অবশ্য প্রচার করা হয়, পৃথিবীর মাটিতে ফিরে আসার পরও লাইকা কিছুদিন বেঁচেছিল। নানারকম পরস্পর বিরোধী তথ্য সামনে আনা হয়। ৯ দিন পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, লাইকার মৃত্যু হয়েছে।
রাশিয়া- আমেরিকা ক্ষমতার লড়াইতে প্রাণ দিতে হয়েছিল লাইকাকে। বিতর্ক হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের রাশিয়ায় পশু অধিকার রক্ষা নিয়ে সেভাবে আন্দোলন ও সচেতনা তৈরী হয়নি। তবু কিছু কণ্ঠ আওয়াজ তুলেছিল লাইকার মৃত্যু নিয়ে। উপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করা হয়েছিল লাইকার মৃত্যুর জন্য।
তবে সেসব বিতর্ক চাপা পড়তেও বিশেষ সময় নেয়নি। বেঘোরে প্রাণ দেওয়া রাস্তার কুকুর তখন রাতারাতি ‘সেলিব্রিটি’। লাইকার বীরত্বের স্মরণে প্রকাশিত হল ডাকটিকিট, এনভেলপ। ২০০৮ সালে মস্কোতে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়।
লাইকার মৃত্যুর পর বেলকা এবং স্ত্রেলকা নামে দুই সারমেয় পাড়ি দিয়েছিল মহাকাশে। তারা অবশ্য সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছিল পৃথিবীর মাটিতে।
কালপুরুষের পায়ের তলায় যে সারমেয়র কল্পনা মানুষ করে আসছে যুগ-যুগান্ত ধরে লাইকা, বেলকা, স্ত্রেলকা যেন অজান্তেই হয়ে ওঠে তার প্রতিনিধি...