আসানসোলে উই ঢিবীকে দেবী দুর্গা রূপে পুজো করা হয়

আসানসোল রেলস্টেশন থেকে উষাগ্রাম পৌঁছে অটো বা বাস পথে যেতে পড়ে এই গ্রাম। ঘুষিক। প্রায় তিন-চারশো বছর আগের কথা। এই গ্রামের হাজরা বাড়িতে প্রতি বছর ঘটা করে দুর্গাপুজো হত।

একবার দুর্গাপুজোর  সময় দেবীর সামনে নৈবেদ্য সাজানো হচ্ছিল। পূজারী এবং তাঁদের সাহায্যকারীরা ধূপ,ধুনো জ্বেলে দেবীকে বরণ করছিলেন। প্রদীপের শিখা জ্বলছিল। সকলেই যখন দেবীর বরণ এবং বন্দনায় ব্যস্ত হঠাৎ দেখা যায় প্রদীপের শিখা থেকে লেগে যাওয়া আগুনে দুর্গা মায়ের চুলে আগুন ধরে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নেভানো হয়। কিন্তু ঠাকুরের মূর্তির চুল ততক্ষণে অনেকটাই পুড়ে গিয়েছিল। এই পুড়ে যাওয়া মূর্তিতে পুজো হওয়া সম্ভব ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে সেই মূর্তির পুজো বন্ধ হয়ে গেল। এরপর থেকে আসানসোলের হাজরা বাড়িতে মূর্তি তৈরি করে পুজোর প্রথাই উঠে যায়। পরবর্তী সময়ে মূর্তির পরিবর্তে ঘটে পুজো করা হত। স্থানীয় মানুষরা তাই এই বাড়ির দুর্গাপুজোকে বলতো পাতিপুজো।

এই হাজরা বাড়ির এক উত্তরসূরী হরিপদ হাজরা পরবর্তীকালে পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে দিবাকর হাজরা পুজোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এই সময় একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে। একবার দিবাকর হাজরা দেখতে পান দুর্গা মন্দিরের ভেতরের মেঝেতে একটি বিরাট উইয়ের ঢিবি তৈরি হয়েছে।। খুব অল্প দিনের মধ্যেই এই ঢিবিটি বৃহৎ আকার ধারণ করে। ঢিবিটি দেখে সেটি নষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন দিবাকরবাবু। কারণ উইপোকা থেকে জামাকাপড় এবং বইপত্র সমস্ত কিছুই নষ্ট হয়। পরিকল্পনামাফিক এই উইপোকার ঢিবি ভেঙে ফেলতে গেলেই দিবাকরবাবু স্বপ্নে দেবী দুর্গার দর্শন পেয়েছিলেন। মা দুর্গা তাঁকে বলেন এই ঢিবিকে পরের বছর থেকে মা দুর্গা রূপে যেন পুজো করা হয়। ঘটপুজো নয় উইঢিবির পুজোর মাধ্যমে মা পুজো নিতে চান। এদিকে দিবাকরবাবু প্রথমটায় বিশ্বাস করেননি। বেশ কয়েকদিন দুর্গা মন্দিরে যাওয়াও বন্ধ করে দেন।

তারপর একদিন হঠাৎ করে গিয়ে দেখেন উইপোকার ঢিবিটা লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকসমেত মা দুর্গার কাঠামোর মত দেখতে হয়েছে। সেই থেকে ওই উইপোকার ঢিবি ভাঙা হয়নি। হাজরা বাড়িতে সেই থেকে উইপোকার ঢিবি দুর্গারূপে পূজা করা শুরু হয়।

দুর্গাপুজোর চার দিন এই উই দুর্গার পুজো চলে। বর্তমানে ঢিবির সামনে একটি ঘট স্থাপন করে পুজো করা হয়। এই ঘটটির স্থানীয় নাম বারি। বারি শব্দের অর্থ জল। পুজোর দায়িত্ব পালন করেন কার্তিক হাজরা।

ষষ্ঠী থেকে দশমী নানা উপচারের মাধ্যমে পুজো করা হয়। ষষ্ঠীর দিন এখানে বাঁশ আর কাপড় দিয়ে নৌকোর মত করে দোলা তৈরি করা হয়। সপ্তমীর দিন সকালে দুজন যুবক এই দোলায় করে কলাগাছ, বেলপাতা সমেত নবপত্রিকা নিয়ে নতুন পুকুরে যায়, তারপর নবপত্রিকাসমেত ঠাকুরকে আহ্বান জানিয়ে বাড়ি ফেরা হয়। এরপর শুরু হয় পুজো।

অষ্টমীর দিন রাজেশ্বর ছাগল বলি হয়। রাজেশ্বর ছাগল মানে এক রঙের ছাগল। নবমীর দিন এই বলির পাশাপাশি আখ এবং চাল কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। পুজোর প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের ফলমূল, মিষ্টি, ঘি আর দুধ ঢেলে মাখা দেওয়া হয়। এছাড়া লাড্ডু তৈরি করা হয় এবং লুচিও ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। উইঢিবিকে মা দুর্গা কল্পনা করে পুজো করা হয় বলে আলাদা করে মূর্তি বিসর্জন দেওয়ার প্রথা এখানে নেই। দশমীর দিন নিয়ম মেনে ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...