আমাদের দেশে গুরু-শিষ্য পরম্পরা বহু প্রাচীন। আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের পূর্ণিমা তিথিটিকে গুরু পূর্ণিমা নামে অভিহিত করা হয়। গুরু পূর্ণিমা ভারতের প্রাচীনকাল থেকে গুরু-শিষ্যদের এক উৎসব। গুরু-শিষ্যের মহান সম্পর্কের উদযাপন হয় এই পূর্ণিমায়। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে গুরুকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। মা-বাবার পরেই রয়েছেন যারা, সেই শিক্ষক ও গুরুদের জন্য গুরু পূর্ণিমা শ্রেষ্ঠতম দিন। সংস্কৃতে 'গূ' শব্দের অর্থ হল অন্ধকার। গুরু শব্দের মানে হল যিনি অন্ধকার দূর করেন। শিক্ষক বা গুরু আমাদের মনের সব সংশয়‚ সন্দেহ‚ অন্ধকার‚ জিজ্ঞাসা দূর করেন। নতুন পথের দিশা দেখান। তমসা থেকে জ্যোতির্ময়ের পথে চালিত করেন গুরু।
শাস্ত্র বলছে, ''অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকায়া, চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ"। অর্থাৎ, অন্ধকার, তিমির সরিয়ে যিনি আমাদের জ্ঞানের দিকে নিয়ে যান। তিনিই 'গুরু' বলে অভিহিত হন। গুরু এবং দেবতা একই মর্যাদার অধিকারী। কারণ সদগুরুর কৃপায় ঈশ্বর দর্শনও হতে পারে; গুরুকৃপা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। বিদ্যা অধ্যয়ন ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতেও গুরুশিষ্য পরম্পরা বিদ্যমান। গুরুপূর্ণিমার দিনে গুরুপূজনের বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। এইদিন শিষ্যগণ গুরু আরাধনায় ব্রতী হন।
আষাঢ় পূর্ণিমা তিথিতে ঋষি পরাশর এবং কৈবর্ত কন্যা মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর জারজ সন্তান মহাভারত রচয়িতা মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই এই দিনটি ব্যয় জয়ন্তী নামেও পরিচিত। এদিন ব্যাস পুজো করার প্রথা প্রচলিত আছে। মহর্ষি বেদব্যাস মানবজাতিকে প্রথম চারটি বেদের জ্ঞান দেন। তাই তাঁকে প্রথম গুরুর উপাধি দেওয়া হয়। বেদব্যাসই অখণ্ড বেদকে চারভাগে বিভাজিত করেছিলেন। তাই তাঁর নাম হয় বেদব্যাস। গুরুপূর্ণিমাকে ব্যাস পূর্ণিমাও বলা হয়। তিনি বৈদিক স্তোত্রসমূহ সংগ্রহ করে চার ভাগে বিভক্ত করে, চার বেদ রচনা করেন। চারটি বেদ হল ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। তিনি এই বেদজ্ঞান তার চার প্রধান শিষ্য পৈল, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি, এবং সুমন্তকে শিক্ষাদান করেন। তাঁকে আদিগুরুও বলা হয়। তিনি ব্রহ্মসূত্রও রচনা করেন, ব্রহ্মসূত্র লেখাও এদিনই সমাপ্ত হয়েছিল। জৈন ধর্মে এই দিনটি ত্রিনক গুহ পূর্ণিমা হিসেবে পালিত হয়।
আবার যোগশাস্ত্র অনুযায়ী, মহাদেব হলেন আদি গুরু। তাঁর শিষ্য হলেন সপ্তর্ষির সাতজন। এই গুরুপূর্ণিমার দিনই ভগবান শিব আদিগুরু হিসেবে আবির্ভূত হন। কথিত আছে, বহু বছর আগে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে এক যোগী আবির্ভূত হন। তিনি আবির্ভূত হতেই বিপুল জনসমাগম হল। কিন্তু তার কোন প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল না, যোগীর গণ্ডদেশ বেয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ছিল। সবাই সেখান থেকে চলে গেলেও রয়ে গেলেন সাতজন। যোগী চক্ষু উন্মীলন করলে, ওই সাতজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন সেই সময় তিনি কী অনুভব করছিলেন। উত্তর না দিয়ে তাঁদের মানসিক প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে আবার চোখ বুঝলেন। এরপরে দিন, মাস, বছর অতিক্রান্ত হল, কিন্তু যোগীর দৃষ্টি তাদের উপর পড়ল না। দীর্ঘ ৮৪ বছর অতিক্রান্ত, দক্ষিণায়ন শুরু হল যোগী আবার তাঁদের দিকে চোখ মেলে তাকালেন। আর ওই সাতজন দীপ্তিময় আধারে পরিণত হলেন। প্রতি পূর্ণিমার দিন ওই যোগী দক্ষিণ দিকে ঘুরে বসতেন ওই সাতজনের গুরু হিসেবে। আদপে যোগী হলেন শিব, তিনি জগতের আদিগুরু। এই সাতজন শিষ্য হলেন সপ্তর্ষি— অত্রি, পুলহ, পুলস্ত, ক্রতু, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, মারিচী।
বৌদ্ধ ধর্মেও গুরুপূর্ণিমার গুরুত্ব অসীম, বোধিজ্ঞান লাভের পরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় প্রথম উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ। কথিত আছে, বুদ্ধদেব নিরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষের নিচে বসে জ্ঞান লাভ করার পাঁচ সপ্তাহ পরে বুদ্ধগয়া থেকে সারনাথে চলে যান। সেখানে তিনি তার পাঁচ পুরনো সঙ্গীকে প্রথম বাণী প্রদান করেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এই পাঁচজন তার ধর্মের বাণী সহজে বুঝতে এবং আত্মস্থ করতে পারবেন। আষাঢ় পূর্ণিমার দিন বুদ্ধদেব তাঁর প্রথম পাঁচ শিষ্যকে বাণী দান করেছিলেন। ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে এইদিন থেকে শুরু করে চার মাস পরিব্রাজক সাধুসন্তগণ কোন বিশেষ স্থানে অবস্থান করে তাদের শিষ্যদের জ্ঞান দান করেন।
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু‚ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরং ব্রহ্মম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ
অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হলেন জগতের গুরু। তারাই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের জ্ঞান পরম ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। আজকের দিনে সকল গুরুর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাই।