সোমবার ইসরো চাঁদের আরো কাছ থেকে তোলা চন্দ্রযান-২-এর ছবি প্রকাশ করল। সেই ছবিতে চাঁদের বেশ কয়েকটা গহ্বর(ক্রেটার) নজরে এসেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই গহ্বরগুলি আসলে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ-যেগুলি অতীতে সক্রিয় ছিল। বর্তমানে সেই আগ্নেয়গিরিগুলি মৃত। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে চাঁদের পিঠে উল্কা-সহ বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু আছড়ে পড়ার ফলে এই ধরণের কিছু গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,৩৭৫ কিমি উচ্চতা থেকে টেরেন ম্যাপিং ক্যামেরা-২-এর সাহায্যে ওই ছবিগুলি তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরো। ইসরোর তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, 'জ্যাকসন' নামের গহ্বরটি চাঁদের উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। সেটি ৭১ কিমি চওড়া। রয়েছে 'ম্যাক' নামের একটি গহ্বর। 'মিত্র' নামের গহ্বরটি ৯২ কিমি চওড়া এবং 'করোলভে' নামক গহ্বরটি ৪৩৭ কিমি চওড়া।
তার মধ্যে আরো ছোট ছোট অনেক গহ্বর রয়েছে। এছাড়াও টেরেন ম্যাপিং ক্যামেরার অপর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে 'সামারফিল্ড' নামক গহ্বর, যা ১৬৯ কিমি চওড়া এবং 'কির্কউড' নামক গহ্বর, যা ৬৮ কিমি চওড়া।
এছাড়াও ছবিতে দেখা যাচ্ছে, 'প্লাসকেট'(১০৯ কিমি চওড়া), 'রোজদেসভেনসিকি'( ১৭৭কিমি চওড়া), 'হার্মিট'(১০৪ কিমি চওড়া এবং সৌর জগতের অন্যতম শীতল অঞ্চল)-এর ছবি।
এগুলির মধ্যে জার্মান পদার্থবিদ আর্নল্ড সামারফিল্ড-এর নামানুসারে সামারফিল্ড গহ্বরটি নামাঙ্কিত হয়েছে। যিনি অটোমিক এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সের দিকপাল ছিলেন। আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ড্যানিয়েল কির্কউড-এর নামে রয়েছে অপর একটি গহ্বর। এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আমাদের বাঙালি তথা ভারতীয় বিজ্ঞানী 'পদ্মভূষণ' শিশিরকুমার মিত্রের নামে নামাঙ্কিত 'মিত্র' গহ্বরটি। ভারতে আয়নোস্ফেরিক সায়েন্স, রেডিও সায়েন্সের জনক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা এই বিজ্ঞানী। তাঁর মৃত্যুর ৫৬ বছর পর উজ্জ্বল হলেন তিনি এই ছবির মাধ্যমে।
চাঁদে অসংখ্য গহ্বর রয়েছে। কোনওটি একেবারে শুরুর সময়ে কোনওটি পরবর্তীতে প্রবল গতিবেগে আছড়ে পড়া গ্রহাণুর আঘাতে তৈরী, যাদের বলা হয় ইম্প্যাক্ট ক্রেটার। নাসার হিসাব অনুযায়ী ১ কিমি ব্যসের গহ্বর রয়েছে দশ লাখেরও বেশি, ২০ কিমি ব্যসের গহ্বর প্রায় হাজার পাঁচেক। চাঁদের উত্তর গোলার্ধের 'মিত্র ক্রেটার' দ্বিতীয় তালিকায় পড়ে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিয়নের গেজেটিয়ার অফ প্ল্যানেটারি নোমেনক্লেচার ১৯৭০ সালে শিশিরকুমার মিত্রের নামে একটি ইম্প্যাক্ট ক্রেটারের নামকরণ করে। এমনই একটি ক্রেটার রয়েছে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম 'বোস' নামে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতে রেডিও প্রযুক্তি, আয়নোসফোরিক সায়েন্সের পথিকৃৎ তিনিই। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০ কিমি পরে কয়েক হাজার কিমি পর্যন্ত ছড়ানো মহাকাশ আয়নমণ্ডল নাম পরিচিত। দূরপাল্লার রেডিও যোগাযোগের জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই আয়নমণ্ডল নিয়েই আজীবন গবেষণা করে গেছেন অধ্যাপক শিশিরকুমার মিত্র। সুযোগ করে দিয়েছেন উচ্চশিক্ষারও। যে কথা বারবার স্বীকার করেছেন বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ সি ভি রমন ছাড়া তিনিই একমাত্র পদার্থবিদ, যিনি নোবেল কমিটির কাছে চারবার প্রাপকের নাম মনোনীত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রতিবারই তিনি মেঘনাথ সাহার নাম পাঠান। তিনি ১৯৫৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সঙ্গে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
স্কুল শিক্ষক বাবা ও ডাক্তার মায়ের পুত্র সন্তান শিশিরকুমার জন্মগ্রহন করেন ১৮৯০ সালে। ভাগলপুরে স্কুলের পড়াশুনো শেষ করে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেল পেয়ে পাশ করেন শিশিরকুমার মিত্র এবং শিক্ষকতা করেন ভাগলপুর, বাঁকুড়া এবং শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ করেছেন জগদীশচন্দ্র বসুর কাছে। সিভি রমনের শিষ্য হিসেবে কাজ করছেন অপটিক্স নিয়ে। ১৯২০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি দেন ফ্রান্স। সেখানে মাদাম কুরির ল্যাবে কাজ করার সুযোগ পান। এরপর কাজ শুরু করেন বেতার প্রযুক্তি নিয়েও। পরে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বদান্যতায় কলকাতায় ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে। ১৯২৫ সালে ওয়্যারলেস ল্যাবরেটরি, রেডিও ট্রান্সমিটিং স্টেশন তৈরী করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স প্রতিষ্ঠানটি তাঁর হাতেই তৈরী। ১৯৫৫ সালে অবসর গ্রহণের পর 'দি আপার অ্যাটমোস্ফিয়ারে'র লেখক মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রশাসক হিসেবেও কাজ করেছেন।
আগামী ২ সেপ্টেম্বর চন্দ্রযান থেকে চাঁদের কক্ষপথে আলাদা হয়ে যাবে ল্যান্ডার বিক্রম। তার পর চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে দু'টি বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি উচ্চতা যখন ১০০ ফুট হবে, তখন ধীরে ধীরে চন্দ্রপৃষ্ঠে নামতে শুরু করবে সেটি। ৭ সেপ্টেম্বর তা চাঁদের দক্ষিণ মেরু স্পর্শ করবে বলে আশাবাদী ইসরোর বিজ্ঞানীরা। এই অভিযান সফল হলে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জল এবং খনিজ পদার্থ খুঁজতে সুবিধা হবে বিজ্ঞানীদের।
#ISRO
— ISRO (@isro) August 26, 2019
Lunar surface imaged by Terrain Mapping Camera-2(TMC-2) of #Chandrayaan2 on August 23 at an altitude of about 4375 km showing craters such as Jackson, Mach, Korolev and Mitra (In the name of Prof. Sisir Kumar Mitra)
For more images please visit https://t.co/ElNS4qIBvh pic.twitter.com/T31bFh102v