শাল-পিয়ালের দেশ দীঘা

চারদিকে লাল পাহাড়। মাঝখানে ছোট্ট এক জনপদ। মালভূমি ঘেরা সেই জনপদের নাম 'ঘাটশিলা'। বড় আপন। টিলা-পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে দীর্ঘদেহী পর্বতের মতো বিস্ময়, সম্ভ্রম জেগে ওঠে না, বরং তারা হাতছানি দেয় আটপৌরে টানে। অনেকটা পাশের বাড়ির চেনা কিশোরীর মতো। একধারে রুক্ষ, লাল মাটি। অন্যদিকে অরণ্য সবুজ। মাঝে মাঝে গভীর চোখের নীরবতায় মায়া চোখের জল। ঝরঝর উচ্ছলতার ঝর্নাগুলো পথ চলতি আবিষ্কার। সফেন স্রোতে খিলখিল তাদের হাসিতে অবগাহনের আহ্বান। শহুরে চোখের ধূলো মাখা দৃষ্টি ধুয়ে যায় মুহূর্তে।
ভোরবেলার নরম আলো মেখে ট্রেনে চেপে বসলেই বদলাতে শুরু করে দেখা। যেন চোখ থেকে খুলে পড়ে গান্ধারীর বাঁধন।
ধীরে ধীরে মাঠ, ধানক্ষেত, পুকুর, নদী পেরিয়ে লোহার সেতুর ওপর দিয়ে ঝমঝমিয়ে চলে যায় ট্রেন। চোখের মধ্যে অলস-পরিশ্রমী মুখ। ছবি আঁকতে থাকে মন। কত রঙ! কত ক্যানভাস!
রেলের কামরার হাসি, গান, গপ্প-গাছা পার করে হাওয়ার স্পর্শ লাগে গালে। ঘন্টা পাঁচেকের মধ্যেই ট্রেন থেমে যায় ঘাটশিলা স্টেশনে।
আমাদের গন্তব্য 'দীঘা'। ঘাটশিলার এক গ্রাম। সেখানে অপেক্ষায় 'আরণ্যক অতিথিনিবাস'।
গাড়ি স্টেশনে হাজির আমাদের নিতে। অতিথিনিবাসের দায়িত্ব। ততক্ষণে নাক ডুবে যেতে শুরু করেছে শাল-পিয়ালের গন্ধে। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারার মতোই এই পান্থশালা।
জানলা খুললেই বৃত্তাকার মালভূমির সারি।
আহা, স্বর্গের কাছাকাছি।
এবার তো চারিদিক ডানা মেলার প্রস্তুতি শুরু। পথ বড় টানে। মেঠো পথ। কালো মসৃণ ঝকঝকে পিচঢালা পথ।
সে পথ ধ'রে বুরুডি লেক। সূর্য পাটে বসছে। আবির মাতাল আলোয় চোখ ঢেকে যাচ্ছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে গভীরে। বদলে দিচ্ছে মন।
ধারাগিরি ঝর্ণা একেবারে অরণ্যের অন্তরে। সেই ঝর্ণার জল মানুষ অরণ্য আর পাহাড়ের রুক্ষ পাথর ডিঙিয়ে ঘরের জন্য নিয়ে যায়। হাতি আসে জল খেতে।
গাড়িতে কয়েক কিলোমিটার গেলেই বিভূতিভূষণের বাড়ি।ফুলডুংরী পাহাড়। বাড়ির অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়। আধুনিকতার পোঁচ লেগেছে তার গায়ে।
আমি অপুকে খুঁজে বেড়াই তাঁর পাণ্ডুলিপির মধ্যে, যা সংগ্রহ করে রাখা। কাঁচের ঘেরাটোপে।
কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের কারুকাজ মুগ্ধ করে। আনমনা হই পাশের পাহাড়ের ঘন মহীরুহের আকাশ পানে চেয়ে থাকা দেখে।
বেশ কিছু জায়গায় দেখলাম জৈব চাষ হয়েছে। বেশ সতেজ। সবুজ। আশা জাগানিয়া।
সোলার সিস্টেমে আলো জ্বলে রাস্তার দু'ধারে। গ্রামগুলো এতো পরিষ্কার, তকতকে!
মনে হয়, এখানে ব্যাধি কাছে ঘেঁষতে পারেনা। দিনের বেলা হাঁড়িয়া বিক্রি করেন মহিলারা। ঝকঝকে বাটি আর মাটির কলসী।
এখনও এখানে সন্ধে নামে নিঝুম হয়ে। সিরিয়ালের ঘনঘটা কোথাও নেই। মাটির বাড়িতে আলিম্পন। আপ্যায়ন করে সাদরে মানুষ তাদের অন্দরে। উঠানে তুলসী মঞ্চ। দেখি তাদের। মন কেমন করে ভারী। ভীষন জলের কষ্ট। কুণ্ঠিত হই,আমরা কত জল অনায়াসে অপচয় করি ভেবে। জানি, বিস্মৃত হবে এ ভাবনা, এ ছবি, দুদিনেই।
সুবর্ণরেখার আকাশনীল জল আদেখলে করে দেয়। নিমেষে বয়স ভুলি। উচ্ছল হয়ে উঠি শিশুর মতোই।
প্রকৃতি এখনও প্রাণপণ উদ্ভাসিত এই মালভূমির দেশে। জীবন গ্লানিহীন। জলে, জঙ্গলে, পাহাড়ে বিছিয়ে সরলতা।
মালভূমির নানা রঙের সবুজ আন্তরিক আহ্বান করে যাচ্ছে, 'এসো হে মানুষ, প্রকৃতির সন্তান হও'।
আমাদের ফিরে আসতে কান্না পায়, যদিও জানি, এ কান্নার দাগ দুদিনেই মুছে যাবে।
সুবর্ণরেখা, আমাদের নীল স্বপ্ন‌ দিও ঘুমের মধ্যে। জাগিয়ে দিও।

ছবি:লেখক

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...