আমাদের বাঙালিদের মধ্যে অনেকদিন আগে থেকেই দক্ষিণী খাবার যথেষ্ট পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। যদিও কিছু মানুষের কাছে একটু একঘেয়ে লাগে দক্ষিণী খাবার গুলো, কিন্তু অনেক বাঙালিরাই এই খাবারগুলি নিজের করে নিয়েছেন। বুঝতেই পারছেন আমি বলছি মূলত ইডলি, বড়া এবং ধোসা-র কথা। ধোসা যাও বা একটু মুখরোচক খেতে, কিন্তু ইডলি অনেকের কাছেই একটু একঘেয়ে।
শুধুমাত্র সকালের ব্রেকফাস্ট হিসেবে এবং পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে এই খাবারের কদর রয়েছে। তো এই একঘেয়ে খাবারটিকেই আকর্ষণীয় করে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে গেছেন 'ইডলি ম্যান'। এম এনিয়াভান। লোকজন চেনে 'ইডলি এনিয়াভান' নামে। কোয়েম্বাটুরের বাসিন্দা এনিয়াভান এখন পাকাপাকিভাবে ইডলির ব্যবসা চালাচ্ছেন চেন্নাইতে। তাঁর দোকান 'মালিপ্পো ইডলি'তে নিত্যদিন হাজার মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।
গোল গোল চাঁদের মতো দেখতে মেথি বাটা আর নারকোলের গন্ধ মাখা সাদা ইডলিতে যাঁদের অরুচি, তাঁরা এনিয়াভান-এর তৈরী চকোলেট ইডলি ট্রাই করতে পারেন। রামধনু রঙে রঙিন ইডলি পাবেন যার টপিংয়ে মাখিয়ে দেওয়া হবে কমলালেবুর রস, পাবেন কুংফু-পান্ডা ইডলি। পেঁয়াজ, রসুন, ক্যাপসিকাম দেওয়া পিৎজা ইডলিও পাবেন এখানে। দক্ষিণের সঙ্গে কন্টিনেন্টাল ছোঁওয়া। নয় নয় করে প্রায় ২০০০ রকমের ইডলির ভ্যারাইটি পাবেন এই দোকানে।
তাই তো তিনি ইতিমধ্যেই 'গিনেস বুক অফ রেকর্ডে' নাম করে ফেলেছেন। তাঁর এই ইডলি প্রীতির কথা সুদূর আমেরিকাতেও পৌঁছে গেছে। এই লড়াইকে কুর্নিশ করেছে আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটি। উক্ত ইউনিভার্সিটির তরফে এনিয়াভানকে ডক্টরেট ডিগ্রী দেওয়া হয়েছে।
সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ায় এনিয়াভান খুব কম বয়সেই মাত্র ক্লাস এইট পাশ করে অটোর স্টিয়ারিং-এ পাকা হয়ে ওঠেন। এক মহিলা ছিলেন তাঁর নিত্যযাত্রী। ইডলির বড়ো ক্যান হাতে তিনি চেপে বসতেন অটোতে। বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন ইডলি-সম্বর। সেই যাত্রীর গল্প শুনতেন এনিয়াভান মন দিয়ে। খরিদ্দারদের পছন্দ কেমন তাও শুনে নিয়েছিলেন ওই মহিলার কাছ থেকেই। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর হাতে যেমন স্টিয়ারিং-এর মাধ্যমে গাড়ি মোড় ঘুরত, ঠিক তেমনিভাবেই। অজানার টানে কোয়েম্বাটুর থেকে পাড়ি দিলেন চেন্নাইতে। খুঁজে নিয়েছিলেন একটা ছোট্ট ঘর। সেখানকার ভাঙা ছাদের দালানে স্ট্রিমার চাপিয়ে শুরু হত ইডলি রান্না। খদ্দেরের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা দুজন-তিনজন। তার মধ্যেই একদিন তুমুল বৃষ্টিতে ছাদ গড়িয়ে স্ট্রিমারে জল পড়ে গেল। যা ইডলি বানানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন, সব নষ্ট হয়ে গেল। ক্ষতি হয়ে গেল বেশ খানিকটা। কারন তখন ওই দিয়েই সেদিন এবং পরের দিনের সামগ্রীর যোগান হত। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। বরং আরও জেদ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মনস্থির করে ফেলেন।
শুরু হল এনিয়াভানের এক্সপেরিমেন্ট। স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের তেমন ইডলি পছন্দ নয়, খেয়াল করেছিলেন এনিয়াভান। সাদামাটা ব্রেকফাস্ট-এ তাদের কোনো আসক্তিই নেই। তারা চায় পিৎজা-বার্গার ইত্যাদি আরও মনভোলানো খাবার। তাই তিনি ঠিক করলেন, ইডলির রেসিপিতে চমক নিয়ে বাজারে আনবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। প্রথমে বদল ঘটালেন রঙে। হলুদ, সবুজ, রামধনু রঙা ইডলি কচি পাতার ছাঁচে ফেলে তৈরী করতে লাগলেন। রঙিন ইডলি সকলে প্রচন্ড ভালোবাসলো। খদ্দের বাড়তে থাকলো।
এর পর করলেন স্বাদ ও আকৃতিতে বদল। কখনো চকোলেট সস ঢেলে ইডলি বানালেন হার্ট শেপের, আবার কখনো কমলালেবুর রস ফেলে বানালেন মিকি মাউস। কুংফু পান্ডার আদলে ইডলি মাতিয়ে ফেললো কলেজ স্টুডেন্টদের। একটু বয়স্করা অর্ডার দিলেন নারকোল জলে বানানো সবজি ভরা খুশবু ইডলি। স্কুল পড়ুয়াদের পছন্দ হল পিৎজা ইডলি। চাহিদা বাড়ল কাপ কেকের মতো দেখতে পেস্তা-কাজু ছড়ানো ইডলি। রমরমিয়ে চলছে দোকান। দোকানের সামনে লম্বা লাইন। ইতিমধ্যেই ভাঙা দোকানের জায়গায় দেখা দিয়েছে ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ। যোগ দিলেন ইডলি ফেস্টিভ্যালে। প্রায় ১২৫ কেজি-র ইডলি বানিয়ে নাম লিখিয়ে ফেললেন গিনেস বুক-এ।
এইভাবে এনিয়াভান যখন প্রচারের আলোয় চলে এলেন, তখন তাঁর শৈল্পিক মন আরো কিছু করতে চাইল। বিভিন্ন বয়সের মানুষের পছন্দের কথা মাথায় রেখে একের পর এক নতুন নতুন রেসিপি তৈরী করতে শুরু করেন তিনি। বর্তমানে সেটা দু'হাজারে দাঁড়িয়েছে। তবু বসে নেই তিনি, আরও ভ্যারাইটি রেসিপি এক্সপেরিমেন্ট করে চলেছেন। প্রসঙ্গত উলেখ্য, এনিয়াভান ইডলি বানান নারকেল জল দিয়ে, কখনোই তিনি সাধারণ জল দিয়ে ইডলি বানান না। তাই তাঁর ইডলির স্বাদ অন্যদের তুলনায় একটু আলাদা রকম এবং অবশ্যই স্বাদু।