রোগা ডিগডিগে চেহারা। ছাতির মাপ ২৮ ইঞ্চি।একটু হাওয়ার বেগ দিলেই কাত। তবু অভিনয়ের পোকা নড়েচড়ে বেড়ায় মাথার মধ্যে। উড়ান দেয়। শখের নাটকের দলে সুযোগও মিলে গেল অভিনয় করার। রোগা ঢ্যাঙা চেহারার জন্য নায়কের পার্টে কেউ পাত্তা দেয় না। কিন্তু ডাক পড়ে কঠিন চরিত্রে।
ঢাকার পোলার অভিনয়ে হাঁ হয়ে যায় দর্শক।
একবার 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকে চাণক্য হয়েছে সেই ছেলে। চোখে পড়ে গেল সুশীল মজুমদারের সহকারী ভুজঙ্গ বন্দোপাধ্যায়ের। সোজা বায়োস্কোপের দুনিয়ায়।
ছবির দুনিয়া তাঁকে চিনেছিল চিরকালের সেরা ‘কৌতুক-অভিনেতা’ হিসেবে।আসলে জাত অভিনেতা। সাম্যময় বন্দোপাধ্যায় ওরফে ভানু বন্দোপাধ্যায়। কারও কারও কাছে আবার 'ভেনো'
সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভাষায় এমন অভিনেতা আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকজনকে মাত্র দেখা যায়।
ফিল্ম। থিয়েটার। রেডিয়ো। রেকর্ড। টি.ভি। যাত্রা। অভিনয়ের যত মাধ্যম সবেতেই বলে বলে ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি।
জীবনের প্রথম ছবি। দিনে সে এক কান্ড ঘটেছিল বটে!
সালটা ১৯৪৬। সবে বিয়ে হয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে দ্বিরাগমনের দিনই পড়ল ছবির শুটিং! ভুজঙ্গ বাবু ছুটে এলেন নবাগত অভিনেতাকে ডাক দিতে। এক্ষুনি যেতে হবে স্টুডিয়োতে। দিনটা ২৬ ফেব্রুয়ারী।
পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তী। নবাগতকে দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেল তাঁর। বললেন, ‘রোগাসোগা দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি চরিত্র আছে, সেই পাট করতে কী তিনি রাজী হবেন?’
কোনও অভিনেতা পাচ্ছিল না চরিত্রটি করার জন্য, রাজী হয়ে গেলেন সাম্যময় বন্দোপাধ্যায়।
‘হ্যাঁ’ হতেই তাঁর মুখে মেকআপ দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল ক্যামেরার সামনে।
সেই প্রথম ক্যামেরার সামনে আসা। সেখানেই স্থির হয়ে গেল নিয়তি।
ছবির জগতে তিনি ‘ভানু’। কিন্তু সেই জগতের বাইরেও অন্য এক ‘ভানু’ ছিলেন। তাঁর ব্যপ্তি আরো বিশাল। পর্দায় যার 'এন্ট্রি' মানে দেদার হাসি, বাড়িতে সেই তিনি কিন্তু একেবারে উল্টো। জেদি, ঠোঁটকাটা, মুখের ওপর হক কথা বলতে ডরান না। চাকরি করতেন সরকারি 'আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোল' অফিসে। সেই মাইনের টাকায় নির্ভর করত এমন মানুষ কম ছিলনা।
চারু অ্যাভিনিউ এর বাড়ি তাঁদের কাছে সদা অবারিত দ্বার। ভানু তাঁদের বিপদের ত্রাতা। এই ভানু আড়ালে থাকা এক মানুষ।
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য জ্ঞান ঘোষ, মোহিতলাল মজুমদারের প্রিয় ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জুয়েল বয়’, তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশা অনেক। বন্ধুরা হিংসা করত। কিন্তু তাঁর সেসবে নজর দেওয়ার সময় কোথায়!
তিনি তো তখন সাইকেলের কেরিয়ারে। যে সাইকেলের টান তিনি কোনও দিন ছাড়তে পারেননি।
সাইকেলের মালিকের নাম দীনেশ গুপ্ত। বিনয়-বাদল-দীনেশের ‘দীনেশ’! অসম্ভব ভালবাসতেন ছটফটে ছেলেটিকে। সাইকেলে বসিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।
আজীবন ছিল সেই টান। দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুর দিন বন্ধুরা অনেক খুঁজেও খোঁজ পায়নি তাঁর। লুকিয়ে ছিলেন। হয়ত বানভাসি হয়েছিলেন গোপনে।
দেশপ্রেমের বীজটাকে লালন করতেন গোপনে। সেই আগুন কোনদিন নেভেনি। দীনেশদা'র দেওয়া প্রতিবাদের শিক্ষাটা রয়ে গিয়েছিলেন শিরায় শিরায়। প্রয়োজন হলেই জ্বলে উঠেছে সেই আগুন। জীবন হোক বা সিনেমা্র দুনিয়ায়। বাঁচতে শিখেছিলেন মানুষের মধ্যে।
তাঁর ‘দীনেশদা’কে কোনও দিন ভুলতে পারেননি। সেই টানেই এক দুপুরে ছুটে গিয়েছিলেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ।
আবাল্য বন্ধু শৈলেশ দাস লিখেছেন সেদিনের স্মৃতির কথা।
রাইটার্সে বিশাল ব্যস্ততা। বিনয়-বাদল-দীনেশের প্রতিকৃতি বসবে ঐতিহাসিক অলিন্দে। বহু মানুষ এসেছেন। কিন্তু নাটক সিনেমার জগৎ থেকে কেউ নেই।
হঠাৎ তাঁর চোখ গেল অলিন্দের একেবারে শেষ প্রান্তে। শৈলেশ বাবু দেখলেন, তাঁর বন্ধু বসে আছে। কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে!
‘তুই এসেছিস?’
ভানু বন্দোপাধ্যায় বললেন, ‘আসব না!’
এমন দিনে তিনি দূরে থাকতে পারেন! তাঁর দীনেশদার মূর্তি বসছে, তাই শুটিং ক্যানসেল করে চলে এসেছিলেন অনুষ্ঠানে।
শিকড়ের টান ধারণ করেছিলেন অন্তরে। দেশভাগ, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন তাড়িত করত বারবার। ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন চরিত্রের সঙ্গে। জীবন যোঝার সংগ্রামে তিনি যে আজীবনের যোদ্ধা।
সময় বদলেছে। যুগ বদলেছে। বাঙালির মনে অক্ষয় হয়ে আছে ভানুর আলো। সে আলো ম্লান হওয়ার নয়।