শ্রীরামকৃষ্ণ মেলাতে এসেছিলেন, মিলিয়ে দিয়েছিলেন। কালীর সঙ্গে খ্রিস্ট, খ্রিস্টের সঙ্গে আল্লা, নতুনের সঙ্গে পুরাতন, প্রবীণের সঙ্গে নবীন; আর মায়ের সঙ্গে ধাইমাকে।
ধাইমা ধনি, কামার পরিবারের বউ। সকলে তাই তাকে 'কামারনি' বলেই ডাকে। কত মায়ের প্রসব হয়েছে তার হাত বেয়ে, কত কত শিশু খেলেছে তার কোলে, কত আঁতুড়ে কত কত দিনরাত কাটিয়েছে সে; কিন্তু তৃপ্ত হয়েছে বোধ হয় কেবল শ্রীরামকৃষ্ণ অর্থাৎ সকলের প্রিয় গদাইয়ের ধাইমা হয়ে।
গদাইয়ের পিতা, ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়। মাতা, চন্দ্রমণি। গদাইয়ের জন্মের দিনটি যখন আসন্ন হল, তখন ডাক পড়ল ধাই ধনির। 'কখন কী হয়' ভেবে ক্ষুদিরাম চন্দ্রমণির কাছে তার রাত্রে শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। দিনে কাছাকাছি থাকার কথা বললেন।
ব্যস, এমনি করে কয়েকটি দিন গেল। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ঢেঁকিশালের পাশে ধানসেদ্ধ করবার স্থানটিতে চন্দ্রমণির আঁতুড় হল। সেখানেই ধনির হাত বেয়ে জন্ম হল গদাইয়ের।
কিন্তু, প্রসবের যন্ত্রণা ও ক্লান্তি খানিক প্রশমিত হতেই ছেলেকে বুকে টানতে গিয়ে তাকে আর কোথাও খুঁজে পেলেন না চন্দ্রমণি। খানিক হাতড়েই ধড়াস করে উঠল বুক। হায় হায়, এই তো জন্মালো! চোখের পলক পড়তে-না-পড়তে কোথায় গেল সে! অজানা আশঙ্কায় আর্তনাদ করে উঠলেন চন্দ্রমণি-ও ধনি, কোথায় গেল, কোথায় গেল রে আমার বাছা! বলতে বলতেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
ধনি সদ্যোজাত শিশুটিকে শুইয়ে রেখে একমনে প্রসবস্থানের শুশ্রূষাতেই ব্যস্ত ছিল। তাই চন্দ্রমণির আর্তচিৎকারে সে প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর হুঁশ ফিরতে যেখানে শিশুটিকে রেখেছিল, সেখানে চোখ ফিরিয়ে দেখতে না-পেয়ে সেও চেঁচিয়ে উঠল-তাই তো গো মা, গেল কোথায়!
শুরু হল আতিপাতি খোঁজ। সে এক চরম দিশাহারা অবস্থা! আঁতুরঘরটিতে ধানসেদ্ধর জন্য একখানা উনুনও আছে। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ছেলেকে পাওয়া গেল সেই উনুনের মধ্যে। জন্মজলে হড়কে গিয়ে ছেলে ঢুকে পড়েছিল সেই উনুনের ভেতরে।
আহা রে, ভাগ্যিস তাতে আগুন ছিল না! শুধু ছিল একরাশ ঠাণ্ডা ছাই। তার মধ্যে পড়ে অদ্ভুত ছেলে বাবা, কান্নাকাটির বালাইটুকুও নেই! বরং ধনি যখন তাকে উনুন থেকে তুলল তখন সে কী রূপ--যেন ছাই মেখে একেবারে শিশু ভোলানাথ! মুখে সদাশিবের মিষ্টি মিষ্টি হাসি।
সেই হাসিতে মুগ্ধ ধনি অনুভব করল মাতৃত্বের এক অমোঘ টান। সুগভীর স্নেহে জড়িয়ে ধরল বুকে। মনে হল, যেন কতকালের আপনার ধন। হল আশ্চর্য এক উপলব্ধি, এ-শিশু যেন সাধারণ না, সদ্যোজাত হয়েও তাঁর বুকের সুধায় হয়ে উঠল যেন ছয় মাস বয়সী সন্তান!
কতশত সন্তানের ধাত্রী ধনির সঙ্গে সেই সব সন্তানের আঁতুড় পেরিয়ে কতটুকুই বা যোগাযোগ থাকে! কিন্তু গদাধরের সঙ্গে আশ্চর্য বাৎসল্যে ধনির যোগ রয়েই গেল। বাল্যের চপল বালক গদাধরকে টুকটাক এটা-সেটা বানিয়ে খাইয়ে সে তৃপ্তি পায়। তার মাতৃত্বের আধারটি পূর্ণ হয়। আকাঙ্ক্ষা জাগে পূর্ণ মাতৃত্বের।
ফলে, কোন এক মুহূর্তে সে আবদার করে বসে তার প্রিয় 'গদাই'য়ের কাছে। তারই আবদারে গদাধরও কথা দিয়ে বসেন যে, উপনয়নের সময় তার কাছেই প্রথম ভিক্ষা নিয়ে 'মা' বলে ডাকবেন। তাই শুনেই তৃপ্তিতে ভরে উঠল ধনির বুক।
তারপর এক সময় গদাধরের বয়স ন'বছর পূর্ণ হতেই উপনয়নের প্রস্তুতি শুরু হল। বাবা মারা গেছেন বহুকাল। বড়দা রামকুমার মাথার ওপর। তিনিই কর্তা। তাই গদাধর তাঁকেই বললেন ধনির সঙ্গে তাঁর অঙ্গীকারের কথা। ব্যাপারটা শুনে এমনটা করতে দিতে রামকুমারের মনে সায় দিল না। বললেন, জন্মদাত্রী মাকে বাদ দিয়ে কামারের মেয়ে ধনি প্রথম ভিক্ষাদানের অধিকার পাবে, এ কেমন কথা! এমনটা তো বংশে কোনদিন হয়নি। যা হয়নি, তা কেমন করে হবে!
হবে। যা হয়নি, তাকে হওয়ানোর জন্যই তো গদাধরের জন্ম। তিনি আপন অঙ্গীকারে অটল থেকে স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর ইচ্ছে পূর্ণ না-হলে, তাঁর সত্য রক্ষিত না-হলে উপবীত ধারণই করবেন না!
ব্যস, গদাধর তো নিজের কথা বলে দিলেন, কিন্তু ওদিকে রামকুমারও নিজের অবস্থান থেকে কিছুতেই নড়তে চাইলেন না। দুই ছেলের দড়ি টানাটানির মধ্যে চন্দ্রমণি পড়লেন মহা দোটানায়। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, উপনয়ন-অনুষ্ঠান ভেস্তে যাওয়ার জোগাড় হল।
এই অবস্থায় আসরে নামলেন পিতৃবন্ধু ধর্মদাস লাহা। তিনিই মধ্যস্থ হয়ে রামকুমারকে রাজি করালেন। গদাধরের সত্যরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। তখন খুশি হয়ে গদাধর উপবীত ধারণ করলেন এবং ধনি কামারনিও ব্রহ্মচারী গদাধরকে প্রথম ভিক্ষে দিয়ে 'মা' ডাক শুনে ধন্য হল।
গদাধর সেদিন প্রথা ভেঙে এভাবেই মা এবং ধাইমাকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালির সম্পর্কস্রোতে তৈরি করে দিয়েছিলেন আর এক সম্পর্কসূত্র, যার নাম, 'ভিক্ষা মা'। তাঁর দৃষ্টান্তের পথ বেয়েই ক্রমে কোন কোন ব্রাহ্মণশ্রেণির মধ্যে উপবীতকালে জন্মদাত্রী ছাড়া অন্য নারীর কাছে প্রথম ভিক্ষাগ্রহণ সূত্রে 'ভিক্ষা মা' সম্পর্ক পাতানোর রীতি তৈরি হল। এই সম্পর্ক আজও উপনয়নের প্রয়োজন মিটিয়ে শেষ হয়ে যায় না, মাতৃত্বের সুধা বয়ে রয়ে যায় সারাজীবনের জন্য...