১৩ সংখ্যার গুণফল ভাগ করতেন মাত্র ২৮ সেকেন্ডে। ২০১ ডিজিটের নম্বরের ২৩ তম রুট বের করেছিলেন মাত্র ৫০ সেকেন্ডে। এই সমাধান দিয়েই এক অবিশ্বাস্য মেধাবিনী ১৯৮০ সালে গিনেস বুক অফ রেকর্ডে সোনার অক্ষরে লিখেছিলেন তাঁর নাম! ‘শকুন্তলা দেবী’। লীলাবতীর দেশের মেয়ে তিনি। বাবা নাম দিয়েছিলেন ‘শকুন্তলা’।
মেয়েদের নাকি মাথা নেই অঙ্কে- যে দেশের ঘরে ঘরে ভেসে বেড়ায় এই কথা, সেই দেশের মাটিতেই বেড়ে ওঠা শকুন্তলা গোটা পৃথিবীর কাছে নিজের পরিচয় তৈরী করেছিলেন ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ হিসেবে।
বাবা ছিলেন সার্কাসের খেলোয়াড়। মঞ্চে নানারকম ম্যাজিক দেখাতেন। মেয়েকে নিয়ে বাবা সার্কাসের দলের সঙ্গেই তাঁবুতে থাকতেন। মেয়ের বিস্ময়কর মেধার প্রথম আবিষ্কারক তিনিই।
তাসের খেলা শেখাতে গিয়ে দেখেন মুখে মুখেই টকটক করে বেশ গুণতে পারছে তিন বছরের মেয়ে। তাসের খেলার গুণ-ভাগ-যোগ-বিয়োগ আয়ত্ব করে নিতে পারল আর দু বছরের মধ্যেই। বাবা নিজেও কম জিনিয়াস ছিলেন না, কিন্তু মেয়ে তুখোড়।
১৯২৯ সালে ৪ নভেম্বর কর্ণাটকে জন্ম শকুন্তলার। রক্ষণশীল পরিবারের ভাবনাচিন্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঘর ছেড়েছিলেন বাবা সি ভি সুন্দররাজা রাও। কাজ নিয়েছিলেন সার্কাসে। মেয়ের জীবনও বাবাকে অনুসরণ করেই গন্ডিভাঙ্গা পথেই এগিয়েছিল।
কেমন সেই পথ? শুনলে রূপকথার গল্প ভেবে চমকে যাবেন!
টাকার অভাবে প্রথাগত শিক্ষা জগতে প্রবেশ করতে পারেননি শকুন্তলা। জীবনের প্রথম পর্ব কেটেছিল সার্কাসের তাঁবুতেই। তাসের খেলায় শকুন্তলাকে কেউ হারাতে পারবে না। কিন্তু তাঁর বাবা চাননি মেয়ের জীবনে সার্কাসের প্রভাব পড়ুক। তাই এক অভিনব পন্থা বের করেছিলেন তিনি।
সার্কাসের তাঁবুর বাসিন্দা ছোট্ট শকুন্তলার ‘অলৌকিক’ মেধার কথা তখন ছড়িয়ে পড়েছে লোকের মুখে মুখে। শকুন্তলা নিয়ে তাঁর বাবা এক শো করলেন। স্থান মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে শকুন্তলার ভাষায় সেটাই তাঁর ‘পাবলিক পারফর্ম্যান্স’র ম্যারাথন শুরুয়াত। বোর্ডে লিখে দেওয়া হল জটিল সব অঙ্কের প্রশ্ন। শকুন্তলা সমাধান বের করে দেখালেন। ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপক-অধ্যাপিকা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় মেয়ের ম্যাজিকে মুগ্ধ! একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার জাদু দেখিয়ে বেড়ান মেয়ে, সঙ্গে থাকেন বাবা। বাবার কাছেই যে তার সংখ্যা চেনার হাতেখড়ি।
১৫ বছর বয়সে ডাক এলো লন্ডন থেকে। এই ক্যুইজ কনটেস্টে প্রতিযোগী হলেন শকুন্তলা। জিতলেন সেই প্রতিযোগিতা। প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এরপর একের পর এক দেশ জয়ের গপ্পো জমা হতে লাগল সাফল্যের সিন্দুকে।
কী করে পারতেন শকুন্তলা? কেন তিনি বিশেষ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ১৯৮৮ সালে আর্থার জেসন নামে আমেরিকার এক মনোবিজ্ঞান গবেষক এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখক গবেষক বার্কলে শকুন্তলা দেবীর মনস্তত্ত্বের ওপর পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালিয়েছিলেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফল ১৯৯০তে একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইন্টেলিজেন্স ইন ১৯৮০ (Intelligence in 1980)’। আর্থার জেসন অঙ্কের জটিল পরীক্ষা দিয়েছিলেন শকুন্তলা দেবীকে। কোনও ভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি কোন ব্যতিক্রমী মেধা ও আশ্চর্য দক্ষতার জোরে তিনি মনে মনে এত দ্রুত গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলেন!
তাঁরা বলেন, ‘দেবী অন্যভাবে বড় সংখ্যাকে বোঝে, সাধারণের চেয়ে একেবারেই অন্য পথে’। চোখের দেখায় তিনি যখন সংখ্যা গণনা করেন তা নিজের মতো করে সহজ করে নিতেন’।
শকুন্তলা দেবীর নিজের ভাষায় তাঁর সাফল্য, মেধা, দক্ষতা সবটাই ঈশ্বরের দান। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর প্রথম ‘পাবলিক শো’ একেবারেই পেটের দায়ে। পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে সদস্য। ছ বছরের শিশুর জন্য এ অতি কঠিন লড়াই। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে তাঁর একমাত্র অবলম্বন ছিল অঙ্কের খেলা।
ক্যালেন্ডার গণনার ক্ষেত্রেয় বিস্ময় ছিলেন শকুন্তলা। যে কোনও শতকের তারিখ, দিনক্ষণ বের করে ফেলতেন অনায়াসে। পরে মিলিয়ে দেখা যেত তাঁর হিসেবের সঙ্গে এতটুকু গরমিল হয়নি।
১৯৫০ সালে ইউরোপ ট্যুর করেছিলেন শকুন্তলা দেবী। সেই সমইয় বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক লেসলি মিচেল তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। সেই সময় তাঁকে নিয়ে লেখা প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয় ‘হিউম্যান কম্পিউটার’। শকুন্তলা দেবী কম্পিউটারকেও হারিয়েছিলেন মেধার যুদ্ধে। শক্ত অঙ্ক সমাধানের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল কম্পিউটার আর ‘হিউম্যান কম্পিউটার’র মধ্যে। হার হইয়েছিল কম্পিটারের। সেই অঙ্কের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল কম্পিউটার সূত্রে প্রাপ্ত উত্তর ভুল, সঠিক উত্তর শকুন্তলা দেবীর।
বেশ কিছু বই লিখেছিলেন তিনি। তাঁর গণনার নিজস্ব পদ্ধতির বিবরণ আছে কিছু বইতে।
১৯৬০ সালে পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক বাঙালি আইএএস অফিসারের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন শকুন্তলা দেবী। এক কন্যার জননীও হন। যদিও পরে বিচ্ছেদ ঘটে।
শকুন্তলা দেবী ছিলেন সব দিক থেকে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার মানবী। প্রথা ভেঙ্গে নিজের পথ নিজে তৈরী করে নেওয়ার জোর তাঁর রক্তে। দুরন্ত মেধার অধিকারিণী ছিলেন, তাঁর চলনের পথে বাধা কম আসেনি। তবে সে সব ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সাফল্যের স্রোতে। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে ছিলেন ভীষণ সচেতন। বিয়ের পর স্বামীর পদবী নিতে রাজী ছিলেন না। ষাটের দশকের ভারতীয় সমাজে এ সিদ্ধান্ত খুব গ্রহণ খুব সহজ ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি আমার নিজের নামে রেশন কার্ড চাই। আমাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে দেখা হোক, সেটা আমার অধিকার”। নিজের পরিচয়, পরিচিতি তিনি নিজে গড়েছিলেন। সেখানে অন্য কারুর হস্তক্ষেপ তিনি মেনে নেননি।
শকুন্তলা দেবীর চিন্তাভাবনা, জীবনবোধ ছিল তাঁর মেধার মতোই প্রখর ব্যতিক্রমী। ১৯৭৭-এ ডালাসে সার্দান মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটিতে ৫০ সেকেন্ডে ২০১ ডিজিটের নম্বরের ২৩ তম রুট বের করে যখন বিশ্ব আলোড়ন ফেলেছেন ঠিক সেই বছরেই দেশের মাটিতে অন্য তোলপাড় তুললেন। প্রকাশিত হল তাঁর লেখা বই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ হোমোসেক্সুয়ালিটি’। পুরুষ সমকামী সম্বন্ধে সমকালীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে ছিল সেই বই। গোটা পৃথিবীকে ধরেছিলেন বইয়ের পাতায়। সমকামী, উভকামী, রুপান্তরকামী মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন রসদ সংগ্রহ করতে।
বাঙালি পরিবারে বধূ হয়ে এসেছিলেন, বিয়ের কয়েক বছর পর বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী সমকামী। পৃথক হয়েছিলেন দম্পতি, কিন্তু স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা ছিল গবেষণা ও বই লেখার অনুঘটক। তাঁর লেখা এই বইটিই সম্ভবত এদেশে সমকাম বিষয়ে লেখা প্রথম বই। আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয় বইটি।
সার্কাসের তাঁবুতে শুরু হয়েছিল শকুন্তলার জীবন। শুধুমাত্র মেধার জোরে হয়ে উঠেছিলেন গোটা বিশ্বের বিস্ময়। নিরলস চর্চা আর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার তাগিদ এই তাঁর সাফল্যের অস্ত্র। বাধা এসেছে বহু, কিন্তু মগজ আর হৃদয়ের জোরে সেসব তুচ্ছ করেছেন অবলীলায়।