বাংলার লোককথা অনুযায়ী হনুমানের কলা খাওয়ার সঙ্গে রথযাত্রার মিল ঠিক কোথায় তা খুঁজে বার করা মুশকিল। কিন্তু রথের দিন জগন্নাথ যাই হয়ে যাক না কেন তিনি মাসির বাড়ি যাবেনই যাবেন। পৃথিবী উলটে গেলেও তাঁর মাসির বাড়ি যাত্রা আটকায়, এমন ক্ষমতা কারোর নেই।
কিন্তু এই ক্ষমতা আছে একমাত্র হাওড়ার বাঁদুরি পরিবারের। রথের দিন তাঁদের জগন্নাথ দেব মাসির বাড়ি যান না। পরিবারের ৬০০ বছরের রীতি বাঁদুরি পরিবারে জগন্নাথ দেব, বিকালে এক চক্কর ইতি উতি দেখে, মেলা ঘুরে এসে আবার বসে পড়েন আপন বাটিতেই।
বাঁদুরি পরিবারের জগন্নাথের পথেই চলেন বলরাম সুভদ্রাও। তাঁরাও ওঁর সঙ্গেই জিলিপি পাঁপড় খেয়ে এসে বসে যান হাওড়া কদমতলার মাকড়দহ রোডের বাঁদুরিদের বাড়িতেই।
ইতিহাস বলছে, জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে একটি দারুণ কারুকার্যখচিত রথে চড়ে মিছিলের মধ্যে সরাসরি বের হন। এরপর পুরী মন্দিরের তাঁর নিজ বাড়ির থেকে দুই কিলোমিটার দূরে গুন্ডিচা মন্দিরে ‘মাসির বাড়ি’ যায় তাঁদের রথ। জগন্নাথ ‘মাসির বাড়ি’ থেকে তাঁর প্রিয় পোড়া-পিঠা খেয়ে ফেরত আসেন এক সপ্তাহ পর।
কিন্তু ওদেশ উড্রদেশ বা ওডিশা। এদেশ বাংলা। এখানে এসেই পরিবর্তন হয় অনেক কিছুর। সেই রকম ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের জেলা হাওড়ার এই পরিবারে এসে জগন্নাথের আর মাসির যাওয়া হয়নি। প্রায় ৬০০ বছর ধরে এই নিয়মই চলে আসছে এই পরিবারে।
পরিবারের প্রথম পুরুষ হিসাবে ধরা হয় সূর্য কুমার বাঁদুরি। তিনিই এই পরিবারের রথযাত্রার প্রচলন করেন।
রথযাত্রাকেই পরিবারের উৎসব হিসাবে বেছে নেওয়ার কারন কি?
পরিবারের সদস্য কল্লোলবাবু বলেন, “যত দূর আমরা জানি সেই সময় ওই অঞ্চলে বিশেষ কোনও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল না। পরিবারের সদস্য ও এলাকার মানুষের আনন্দের জন্যই এই রথযাত্রার শুরু।”
খোলা রাস্তায় জগন্নাথকে নিয়ে মাসির বাড়ি যাত্রায় জাত-শ্রেণি-নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণ চলে আসছে মধ্যযুগ থেকে। ওই দিন তিনি মাসির বাড়ি যাত্রা করেন। কিন্তু সূর্য কুমার বাঁদুরি উল্টো পথেই হেঁটেছিলেন সেদিন। তাঁর পরিবারের জগন্নাথ দেবের কোনও ‘মাসি-পিসি’ নেই। বিকেল বেলা তাঁদের রথ বেড়িয়ে বেলিলিয়াস রোডের আশু বোস লেন অবধি ঘুরে, ফের চলে আসে কদমতলার বাড়িতেই।
এর কারণ কী?
বাঁদুরি বাড়ির সদস্যদের মতে, “তাঁদের জগন্নাথ দেবের কোনও মাসির বাড়ি নেই। একটাই ঘর একটাই বাড়ি। তাই রথের দিন বিকেলে ঢাক ঢোল সমারোহে বাঁদুরিদের রথ যাত্রা শুরু করে ফিরে আসে নিজে বাড়িতেই।“
রথের গায়ের চিত্র বেশ আকর্ষণীয়। সেখানে জগন্নাথ দেবের সঙ্গেই স্থান পেয়েছেন শিব, রাধা-কৃষ্ণ। সঙ্গে আবার ইংরেজদের জমানার ফিরিঙ্গিদের ঘোড়ার ছোটানো সাহেবের ছোট ছোট মূর্তির দেখা মেলে রথের গায়ে।
রথের দিন বিশাল পরিবারের প্রত্যেকে হাজির হন বাড়িতে। সকাল থেকে পুজা হয়। বাড়ির মেয়ে বউয়েরাও এই পুজায় বড় ভূমিকা রয়েছে।বাঁদুরিরা আসলে ‘গোপ’ জাত বা শ্রীকৃষ্ণের বংশধর।
ওই দিন সকালে খিচুড়ি ও রাতে লুচি খাওয়া হয়।