লেখক সত্যজিতের জন্ম

সন্দেশের পাতা ভরাতে কলম তুলে নিলেন সত্যজিৎ, ভাগ্যিস সত্যজিৎ কলম তুলে নিয়েছিলেন, নয়ত আমাদের ছোটবেলা এতো মধুর হত কী! ফেলু-শঙ্কু না থাকলে, কী পড়তাম ছোটবেলায়। তাই সত্যজিতের জন্য বলাই যায়, "তুমি না থাকলে ছোটবেলা এতো মিষ্টি হত না!"

সত্যজিৎ নিজে লিখে গিয়েছেন, তিনি চল্লিশ বছর বয়সে প্রথম লিখতে শুরু করেন। এবং দুজন সম্পাদকের একজন সম্পাদক তিনি, কিছু না লিখলে চলেই না, তাই ছড়া অনুবাদ করেন। সন্দেশের পাতা ভরাতে গিয়েই তাঁর পুরদস্তুর লেখক হয়ে ওঠা। আর বাকিটা তো ইতিহাস। সন্দেশের রিসারেকশান কিভাবে হল সেই কাহিনি বলি। প্রথম সন্দেশ শুরু হয়েছিল ১৩২০ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখের দিন। জ্যোতির্ময়ী দেবীর লেখায়,

"নতুন বরষ ভাই আমাদের ঘরে,

সন্দেশ এসেছে আজ নব সাজ পরে।"

ঠাকুরদার শুরু করা পত্রিকা ফের সত্যজিৎ শুরু করেন ১৯৬১ সালে, বাংলা টাইম-লাইন হল ১৩৬৮-এর পয়লা বৈশাখ। যৌথ সম্পাদকের ভূমিকায় পেয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও মা সুপ্রভা দেবীই ছিলেন সত্যজিতের সন্দেশ পুনরায় শুরু করার অনুঘটক। তবে দুটো কাজ সারতে হয় সত্যজিৎকে, এক, ইউ রায় অ্যান্ড কোম্পানির থেকে অনুমতি আদায়। আর দ্বিতীয়টি ছিল একটু চাপের। কারণ ওই সময় সন্দেশ নামে আরেকটি পত্রিকা চলত। চালাতেন তারাপদ সাঁতরা, সেখানে শ্রমিক আন্দোলনের খবর ছাপা হত। সত্যজিতের ভাগ্য সঙ্গ দিয়েছিল। শ্রমিক আন্দোলনের কথা বলা সন্দেশ পত্রিকাটি ১৯৬০-এর আগেই আনিয়মিত হয়ে পড়েছিল এবং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তারাপদ বাবু আর অমত করেননি। ব্যস হইহই করে শুরু হল সন্দেশ। আজও সে চলছে।

Satyajit-Sandesh-Cover

তবে সন্দেশই প্রথম পত্রিকা নয়, যেখানে সত্যজিৎ যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন সত্যজিৎ ও তাঁর বন্ধুরা এক পত্রিকা শুরু করেছিলেন। যার নাম ছিল একেবারে যাতা। পত্রিকার নেপথ্যে কান্ডারি ছিলেন বনফুলের ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, অর্থাৎ টলি পাড়ার ঢুলুদা। তাতে প্রকাশকের জায়গায় লেখা থাকত তুমি, আর সম্পাদকের জায়গায় আমি। প্রচ্ছদ করতেন মানিকবাবু।এই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও কিন্তু রুপোলি পর্দার লোক। ক্যামেরা পিছন থেকে অগ্নিশ্বর, ধন্যি মেয়ে, মৌচাক, নিশিপদ্ম বানিয়েছেন। রাজেশ খান্নার অমর প্রেমের চিত্রনাট্য লিখেছেন। দাদার মতো তিনিও ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন, কিন্তু মাথায় চেপে বসেছিল ছবি বানানোর ভূত।

যদিও শুরুটা অভিনয় দিয়েই হয়েছিল। একদা একটি বিজ্ঞাপন বেরল। কাস্টিং কল! বিখ্যাত পরিচালক কালীপ্রসাদ ঘোষ নতুন সিনেমা বের করবেন; তার জন্য নতুন ছেলে চাই। প্রচুর আবেদনের দরখাস্ত জমা পড়তে লাগল। আজকের দিনে হলে পোর্ট ফোলিও হত। বনফুলের ভাই ডাক্তারি পড়ছেন; কিন্তু সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হতে চান। হিরো হতে চেয়ে বিজ্ঞাপন দেখে তিনি পাঠিয়েদিলেন দরখাস্ত। সিলেক্টও হয়ে গেলেন, ১৯৪৮ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমা ধাত্রীদেবতায় রামরতন মাস্টারের চরিত্রে অভিয়ন করলেন। সেই থেকেই রুপোলি পর্দার যাত্রা আরম্ভ হল। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে চতুর্থ বর্ষেই ডাক্তারির পড়াকে টাটা করেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির ঢুলু বাবু।  ডাক্তারি ছেড়ে স্বনামধন্য একজন পরিচালক হলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। তবে কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমায় পার্ট পাওয়ার জন্য আরও দু’জন চেষ্টা করেছিলেন। কিন্ত তাঁদের ভাগ্যে সে যাত্রায় শিকে ছেড়েনি। তাঁরা সেই সিনেমায় সুযোগ পাননি। কিন্তু সেই দুজন পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন অভিনয় জগতের দুই দিকপাল। জানতে ইচ্ছে হয় না কারা ছিলেন সেদিন লাইনে? বাংলা অভিনয় জগতের দুই কিংবদন্তি জহর রায় এবং শম্ভু মিত্র ছিলেন সেদিন লাইনে।  

ঢুলু বাবুর পত্রিকায় যেমন বাবুর বাবা প্রচ্ছদ করতেন, ঠিক তেমন আরেক জনের পত্রিকাতেও বাবুর বাবা আঁকতেন। সেও বাবুর মতোই। তবে জৈবিক পুত্র না হলেও মানস পুত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এক্ষন পত্রিকার প্রচ্ছদ করতেন সত্যজিৎ। এই ‘এক্ষণ’ নামটিও তাঁরই দেওয়া।

সন্দেশে ফিরি, এই সন্দেশ আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্য গুপীকে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। এক সময় সন্দেশের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের মহানগরে অভিনয়ও করে ফেলেছিলেন। সত্যজিৎ গুপী বাঘা বানাচ্ছেন, বাঘা হিসেবে রবি ঘোষ কনফার্মড। মিলছে না কেবল গুপী। সৌমিত্রও গুপী করার জন্য পীড়াপিড়ি করেছিলেন, মানিক রাজি হননি। তপেন ছিলেন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি ছেড়ে এসে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের নাটকের দলে যোগ দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়ের কাকা, তাঁদের বাড়ির আড্ডাতে গিয়ে তপেনকে দেখেই মানিক তাঁর গুপী রতনকে পেয়ে গিয়েছিলেন। বাকি কাহিনি আমাদের সবার জানা, গুপীর জন্য বিশ্ব বন্দিত হয়েছেন তপেন চট্টোপাধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...