নিরামিষ হেঁশেলের সাতকাহন

'মাছ-ভাত বাঁচে বাঙালি সকল

ধানে ভরা ভূমি তাই, মাছে ভরা জল'

মাছে ভাতে বাঙালি। ‘মাছ’ আর ‘ভাত’ ছাড়া কিছু  ভাবতে পারে না। গাঙ-মাটি আর আমিষের গন্ধে মজে থাকে তার মন।

হেঁশেলে মাছ-মাংসের পদের আধিক্য বাঙালির চিরকালের। কিন্তু তা কেবল ধনী এবং অবস্থাপন্নদের। গ্রামের দরিদ্র মানুষ তার সন্ধান পায় না। তাদের ভাত জোটাতেই সংকটে পড়তে হয় এবং অন্ন সংকট চিরকালীন। অথচ বাড়িতে অতিথির আসা-যাওয়া লেগেই থাকে।

চর্যা পদ বলে, ‘টালত ঘর মোর নাহি পরবেষী । হাঁড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী ।

অতিথির কাছে যাতে লজ্জায় পড়তে না হয় তার জন্য মাঠের শাক, বাগানের সবজি, পথ চলতে পাওয়া ফল-ফুলও আদর পেয়েছিল বাঙালি গৃহিণীর কাছে।

নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্বে) বইতে দেখা যায়, “ভাত সাধারনত খাওয়া হইত শাক ও অন্যান্য ব্যঞ্জন সহযোগে। সেখানে আমিষের দেখা নেই।  

পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ডালের ব্যবহার দেখা যায়নি। বাংলায় ডালের ব্যবহার শুরু হয় চৈতন্য প্রভাবে।

বাঙালির খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে বড় বদল আসে চৈতন্য যুগে। যেন আগাগোড়া দিক বদল। জীব প্রেমের জোয়ার এসে লাগল রান্না ঘরের অন্দরেও।

চতুর্দশ শতক থেকে বাংলায় যে ভক্তিবাদী আন্দোলন শুরু হল তা বাঙালির খাদ্যাভ্যাসকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছিল।     

চৈতন্যের অনুগামীরা মাছ-মাংস আমিষ আহার পরিত্যাগ করল। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস এবং উৎসব-অনুষ্ঠানে বাড়তে লাগল নিরামিষ পদ। যোগ হল নতুন পদ ‘খিচুড়ি’র। চাল, ডাল, ঘি-মশলা সহযোগে এই পদ দেবতাকে নিবেদন করা হত ‘ভোগ’ হিসাবে।

ষষ্ঠ শতাব্দীতে নিরামিষ পদ যেন আরও বেশি সার্বজনীন হয়ে উঠল। তখন আর তা কেবল মাত্র চৈতন্য অনুগামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যে নিরামিষ পদের উল্লেখ আছে। শুক্তো, পাটপাতা ভাজা, বিলিতি আমড়ার চাটনীর কথা বলেছেন। করলা, উচ্ছে দিয়ে রান্না করা ‘শুক্তো’কে ‘তিতা’ বলা হত। 'চৈতন্যচরিতামৃতে' সুকুতা, শুকুতা বা সুক্তা বলতে একধরণের শুকনো পাতাকে বলা হয়েছে।

"বর্তিসা কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,
ঊণ্ডারিত তিন মান তণ্ডুলের ভাত।

পীত সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল,
চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল।

কেয়া পাতের খোলা ডোঙ্গা সারি সারি,
চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি।

দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,
মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।

দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা,
মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকেরা।

ফুল বড়ি ফল মূলে বিবিধ প্রকার,
বৃদ্ধ কুষ্মাণ্ড বড়ির ব্যঞ্জন অপার।

বিয়ে-অন্নপ্রাশনের মতো অনুষ্ঠানে অতিথিদের পাতে ঘি দিয়ে ভাজা হিলেঞ্চা শাক, মুগ ডাল, তিল বাটা, তিল-কুমড়ো, পলতা দেওয়া হত।    

বাঙালি হেঁশেলে নিরামিষের ভান্ডারটিও কম সমৃদ্ধ নয়। অন্নদামঙ্গলে বাইশ ধরনের নিরামিষ পদের নাম পাওয়া যায়। এছাড়া মঙ্গল কাব্যগুলোতেই নিরামিষ সম্ভার কম নেই!

কৌলীন্য প্রথা ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল ভোজনবিলাসী বাঙালির খাবারের অভ্যাসে। কৌলীন্য প্রথার কারণে অকাল বৈধব্যের মুখে পড়তে হত অসংখ্য হিন্দু রমণীকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃদ্ধ , অতিবৃদ্ধর সঙ্গে শিশু বা কিশোরী কন্যার বিবাহ দিতে বাধ্য হত পরিবার। বাকি জীবন অকাল বৈধব্যের যন্ত্রণা। একাদশী-বারব্রত’র কৃচ্ছ সাধনের হাজার এক বিধিতে বাঁধা হতে তাঁদের।

বাড়ির মূল হেঁশেলে রান্না করতে পারতেন না তাঁরা। পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল- এমন হাজার এক ভোজ্যতে ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। আমিষ পদের নাম মুখে আনলে সামাজিক রক্ত চক্ষুর মুখে পড়তে হত।

তাই যেসব সামগ্রীতে নিষেধাজ্ঞা ছিল না সেই সব সামগ্রী দিয়েই যতসামান্য উপকরণে  নিত্য নতুন পদ রাঁধতেন তাঁরা। আলুর দম, বাটি চচ্চড়ি, ধোকার ডালনার মতো পদের উদ্ভাবন হয়েছিল এভাবেই।

আমিষ পদের নিরামিষ সংস্করণ আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা। এঁচোড়, মোচা দিয়ে রাঁধা হত নিরামিষ ডিমের ডালনা, নিরামিষ মাংস।

এখন এই পদগুলোই রোজকার খাদ্যাভ্যাসে মিলেমিশে গিয়েছে।

বাঙালির রান্না এবং খ্যাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস দিক বদল করেছে বারবার। প্রতিবার নতুন সংযোজন সমৃদ্ধ করেছে খাদ্য সংস্কৃতিকে। বৈচিত্র্য এসেছে জীবন যাত্রায়। প্রতিবারের দিক বদলেই লুকিয়ে আছে একটা গোটা জাতি আর সমাজ বদলের ইতিহাসও। কিন্তু সেই ইতিহাস কোনওদিনই যোগ্য গুরুত্ব পায়না!  

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...