ডাক্তারী পড়েও তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সংগীতকে। শ্রোতারা তাঁকে বাংলা ব্যান্ড ‘ক্যাকটাস’-এর গায়ক হিসেবে চেনেন। তিনি ডঃ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তবে আমরা তাঁকে চিনি ক্যাকটাসের ‘সিধু’ নামেই। একটি সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। সেই দিনটা যদি না আস্ত আমরা তাঁকে ‘গায়ক’ হিসেবে চিনতামই না। কিন্তু কেন মাঝপথে ডাক্তারী ছেড়ে নিজের পেশায় ‘গায়ক’ শব্দটি জুড়লেন তিনি?
ছোটবেলা থেকেই সিধু নিজেকে স্থির রেখেছিলেন যে তিনি বড় হয়ে ডাক্তারই হবেন। এটা যদিও তাঁর মায়ের ইচ্ছে ছিল। তবে, ‘রায় পরিবারে’, সিধুর বাবা থেকে শুরু করে দাদু, সবাই ডাক্তার। ফলে, সিধুর মায়েরও ইচ্ছে ছিল তাঁর ছেলেও ডাক্তার হোক। সিধু পড়াশোনাতেও খুবই ভালো ছিলেন। প্রথম থেকেই তাঁকে ডাক্তার হওয়ার দিকে তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর পরিবার।
তবে, ২০০৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা, হঠাৎ এক ঘটনার পরেই, সবকিছু মাঝপথে ছেড়ে দেন সিধু। এরপর জীবিকা হিসেবে সংগীতকেই বেছে নেন তিনি।
ঠিক কী ঘটেছিল সেই সন্ধ্যেতে? চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই গল্প।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘ক্যাকটাস’-এর প্রথম অ্যালবাম। ধীরে-ধীরে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিচ্ছে ‘হলুদ পাখি’র মতন এই ব্যান্ডের অন্য কিছু গান।
এরপর ঠিক দু’বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালে ‘নীল নির্জনে’ ছবিতে ব্যান্ডের সঙ্গীত পরিচলনা করে। আর তারপরেই জনপ্রিয়তা আরও বেশি করে বেড়ে গেল। ‘ক্যাকটাস’-কে আর থামানো যায়নি।
এদিকে সেই সময় সিধু শিয়ালদহের বিআর সিং হাসপাতালে ডিএনবি-র (ইন্টারনাল মেডিসিন) ডিগ্রির ছাত্র। ট্রেনিং বেস্ড ৩ বছরের কোর্স। আর তারপরেই পরীক্ষা। হাসপাতালে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত ডিউটি থাকে তাঁর। এছাড়া সপ্তাহে একদিন ২৪ ঘণ্টার ডিউটি, অর্থাৎ ‘অন কল’ থাকত ছাত্র-ছাত্রীদের। সেই দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যেত মাসের শুরুতেই।
অন্যদিকে, আগে যেখানে মাসে একটা শো হত, সেখানে ‘ক্যাকটাস’ শোয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাত-আটটা।তখন কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে মফস্সল এলাকাতেও শো করতে শুরু করেছে তাঁরা।
ফলে, চাপ বাড়া শুরু হয়ে গেল সিধুর জীবনে। কিন্তু তাঁর দুই বন্ধু, রাহুল এবং জয়দীপ, খুবি সাহায্য করত তাঁকে।
এরপরেই সেই দিনটা এল সিধুর জীবনে। ৩ ফেব্রুয়ারি। সেইসময় ময়দানে কলকাতা বইবেলা হত। এদিন এক প্রকাশনা সংস্থার স্টলে বিকালে গানের আমন্ত্রণ ছিল ‘ক্যাকটাস’ ব্যান্ডের। ফলে, উত্তেজিত সিধু এবং ব্যান্ডের সকলে। তাঁদের কাছে সেই প্রস্তাব ছিল খুবই ‘লোভনীয়’। তবে, সেটা তো হওয়ারই কথা। কারণ সেই সময় ‘ক্যাকটাস ব্যান্ড’ জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।
তবে, একটা সমস্যা ছিল। সেদিনই হাসপাতালে সিধুর ২৪ ঘণ্টার ডিউটি। এবার কি করবে তিনি?
ব্যান্ডের বাকি সদস্যদের অনুরোধ করে যে তাঁকে ছাড়াই অনুষ্ঠানটি করতে। কিন্তু সেই কথায় কেউই রাজি হল না। সিধু ‘ফ্রন্টম্যান’, তাঁকে ছাড়া তো একেবারেই অসম্ভব। এটাই ছিল তাঁদের দাবি। অন্যদিকে, হাসপাতালকে অনুরোধ করেন তারিখ বদলানোর জন্য, কিন্তু কেউই শোনেন নি।
উভয়সঙ্কটে পড়ে যান ডঃ সিদ্ধার্থ। দিশাহারা হয়ে পড়েন তিনি!
এরপর ছাত্রের সমস্যা দেখেই এগিয়ে আসেন সিনিয়র চিকিৎসক ভাস্কর। হাসপাতালের স্যারেরা জানতেন সিধুর গান-বাজনার কথা। বিকেলে এক ঘন্টা হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ার ছিল। তাই সিধুকে তাঁর স্যার ঘণ্টা তিনেকের জন্য বইমেলায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন। বিকাল ৫টায় বেরিয়ে, সন্ধ্যা ৮টায় ফিরে আসবে ছাত্র। সম্মতি দিলেন স্যার।
খুশী এবং উতলা হয়ে সিধু চলে গেলেন বইমেলা। কিন্তু সে তখনও জানতো না তাঁর জন্য এরপর আর কী কী অপেক্ষা করছে। সেই ঘটনা হয়েতো তাঁর জীবনে আগে কখনও হয়েনি। তাই তিনি কল্পনাও করে উঠতে পারেন নি।
বইমেলা হয়েছিল ময়দানে। আর সিধুকে পৌঁছাতে হবে শিয়ালদহে। ফলে, পার্ক সার্কাস হয়েই ফিরতে হবে তাঁকে।
সন্ধ্যেবেলায় ট্যাক্সিতে চেপে হাসপাতালে ফিরছেন সিধু। পার্ক স্ট্রিট হয়ে পার্ক সার্কাস— পুরো রাস্তায় তীব্র যানজট। সেই জ্যাম কাটিয়ে আসতে-আসতে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পেরিয়ে যায়। তিনি যখন পৌঁছলেন, তখন ঘড়ির কাঁটা দাঁড়িয়েছিল রাত সাড়ে নটা! প্রায় ১ ঘন্টা লেট।
এরপর দৌঁড়েই সিস্টারদের কাছে যান তিনি। তাঁদের কাছে শুনলেন যে সেদিনই সন্ধ্যা থেকে হাসপাতালে ৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। আর তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা এতটাই সঙ্কটজনক, যে তাঁদের এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে সোজা আইটিইউ-তে পাঠানো হয়েছে।
নিজেকে অপরাধীর তালিকায় দেখছিলেন সিধু! কারণ, একা হাতে পুরোটাই ভাস্কর স্যার সামলেছেন।
এরপর অপরাধীর মতনই স্যারের ঘরে যান সিধু। প্রথমে যানজটের কথা বললেন তিনি। তারপরেই স্যারের কাছে মন থেকে ক্ষমা চাইলেন। ডিউটি সামলেছেন বলে তাঁর জন্য ধন্যবাদও জানালেন তিনি। সিনিয়র সবকথা শুনলেন। কিন্তু মুখের দিকে তাঁকিয়ে ‘ঠিক আছে’ ছাড়া আর কিছুই বললেন না।
এরপর আবার ডিউটি করতে ফিরে আসেন সিধু। ডিউটির মাঝেই মাঝরাতে হোস্টেলের ঘরে ফিরে আসেন তিনি। ক্লান্ত থাকলেও কিছুতেই দু’ চোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না তিনি। বার-বার সন্ধ্যের ঘটনাটা মনে পড়ছিল। মনের ভিতরে তীব্র আত্মদংশনে দগ্ধ হচ্ছিলেন তিনি।
তখন তাঁর মাথায় একটা জিনিসই ঘুরছিল যে তিনি হয়েতো দু’ নৌকায় পা রেখে চলছেন। মনে হচ্ছিল যে এইভাবে চলা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কারণ রয়েছে। দুটো জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। কোনও মিল নেই। এরপরেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তিনি।
পরের দিন সকাল ৯টায় শেষ হয়ে তাঁর ডিউটি। এরপরেই সারাজীবনের মতন হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান সিধু। সেই সঙ্গে চিকিৎসক হওয়ার সেই ইচ্ছাকেও ছেড়ে আসেন হাসপাতালে। ফোন, চিঠি, যা করার সব করে দিয়ে এসেছেন তিনি। সেদিনের পর আর তিনি কোনওদিনও হাসপাতালের দোরগোড়ার চৌখাট মারাননি।
সেদিনের পর নিজেকে এবং পরিবারকে ছ’মাসের একটা বিরতি দিয়েছিলেন।
২১ বছর পেরিয়ে গেছে।
আজ তিনি নামকরা গায়ক। এক ডাকেই সকলে সিধুকে চিনে যান। সেইদিনের বড় সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছে তাঁর গোটা জীবন।
তিনি এখন সকলকেই বলে যে সেই সময়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হয়ে একটা বিরাট বড় সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। আর তার জন্যই নিজেরই পিঠ চাপড়াতেন চান সিধু।
সংগীত তাঁকে যা দিয়েছেন, সিধুর কাছে যথেষ্ঠ। প্রত্যেক মানুষের কাছ থেকে তিনি যেই ভালোবাসা এবং সম্মানটা পেয়েছেন। সেটা দেখলে তাঁর নিজের মনে ২১ বছর আগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনওরকম অনুশোচনা হয়ে না।
এখন তাঁকে শোনার জন্য অনেক শোতারাই অপেক্ষা করে থাকেন। ‘খোদা জানে না’ গানটির পর, গত বছর শো নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন সিধু। সারা বছরে তাঁর ব্যান্ড ৩০টি শো করেছে। তিনি জানিয়েছেন যে চলতি বছরে ‘ক্যাকটাস’ বেশ কয়েকটি নতুন গান প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে।