ঋষিগণ শিব পুরাণের বায়বীয় সংহিতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে দুগ্ধ প্রাপ্তির জন্য উপমন্যুর তপস্যা ও শিবের বরে দুগ্ধ সমুদ্র প্রাপ্তির কথা বলতে শুরু করেন। ঋষিগণ পবনদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, উপমুন্য নামের এক বালক শৈশব অবস্থা থেকেই ক্ষীরের জন্য তপস্যা করছিলেন। কিন্তু শিশুকাল থেকেই কীভাবে তিনি শিবের প্রতি আসক্ত ও ভক্তিমান হন এবং তার কৃপার প্রতি আস্থা রেখে তপস্যা করতে থাকেন সেই কাহিনী আমাদের কৃপা পূর্বক বলুন।
এর উত্তরে পবনদেব বললেন," উপমন্যু কোনও সামান্য বালক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ধীমান মুনি শ্রেষ্ঠ ব্যাঘ্রপাদের পুত্র। উপমন্যু পূর্বজন্মে সিদ্ধ ছিলেন। তিনি পূর্বজন্মের পূণ্য ফলেই মুনিকুমার রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাগ্যে মহাদেবের অনুগ্রহ লাভ নিশ্চিত ছিল বলে দুগ্ধাভিলাসের জন্য তিনি তপস্যা করেন। এইজন্য শংকর তাকে গণেশত্ব ও চির কুমারত্ব দান করেন। শঙ্করের অনুগ্রহে তার জ্ঞান লাভ হয়। কারণ পণ্ডিতরা কুমার ভাবকেই সাক্ষাৎ শক্তিময় জ্ঞান বলে নির্দেশ করেন। এই জন্যই নন্দীর মতোই তিনি শিব শাস্ত্রের বক্তা হন। দুগ্ধের জন্য তার দুঃখিনী মাতার বচনই তার শিবজ্ঞান লাভের কারণ। এই বলে পবনদেব ভক্ত উপমুন্যর ভক্তির কাহিনী বলতে শুরু করলেন।
শৈশবে একদিন তার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে বৎস দুগ্ধ ই বা কোথায় আর বনবাসী আমরাই বা কোথায়? কৃষিকার্য অভাবে দারিদ্রবশত অভাগিনী আমি ডালে পিঠে গুলে এই মিথ্যা দুগ্ধ তোমায় দান করছি। তুমি মাতুল গৃহে ঘন দুগ্ধ অল্পমাত্র পান করে দুগ্ধের আস্বাদ অনুভব করেছ, এখন সেই আস্বাদ স্মরণ করে সেই দুগ্ধ না পেয়ে তুমি কাঁদছো। মহাদেবের কৃপা ছাড়া তোমার কপালে দুগ্ধ নেই পার্বতীসহ মহাদেবের চরণে কোনও বস্তু অর্পণ করলে তবে সম্পদ পাওয়া যায়। আমরা পূর্বে ধন প্রাপ্তির জন্য শিবের অর্চনা করিনি, এজন্যই আমরা দরিদ্র হয়েছি। সেই জন্যই আমাদের ঘরে কোন দুগ্ধ নাই।
মাতার এই দুঃখিত কথা শুনে ঋষি কুমার উপমন্যু এক দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, যদি দেবী পার্বতী সহ শিব বিদ্যমান থাকেন, তাহলে আমার দুঃখের কারণ নেই। আমি তার প্রসাদে অবশ্যই দুগ্ধ সমুদ্র প্রাপ্ত হব।
উপমুন্যর মাতা তখন বললেন, “হে পুত্র যদি থাকেন এই সন্দেহের কথা কেন বলছ তুমি? সেই পরমেশ্বর শম্ভু নিশ্চয়ই আছেন এবং তিনি এই জগত সৃষ্টির কারণ। ব্রহ্মা ও দেবগন তারই প্রসাদে দেবত্ব লাভ করেছেন। আমরা সকলেই তাঁর দাস। 'নমঃ শিবায়' এই মন্ত্রে সকলেরই অধিকার আছে। সুতরাং এই মন্ত্র সকলকেই রক্ষা করতে পারে। অতএব তুমি অন্য কোন মন্ত্র গ্রহণ না করে কেবল এই মন্ত্রে একাগ্রচিত্তে তার উপাসনা করো। আমি তোমার পিতার থেকে এই মন্ত্রটি প্রাপ্ত হয়েছি এটা তুমি গ্রহণ করো। এই ভস্ম বিরজাহোমের অনল দ্বারা সিদ্ধ এবং সকল আপদের নিবারক। আমি তোমাকে এই ভস্মসহ নমঃ শিবায় এই মন্ত্র দান করলাম। এই মন্ত্র জপ করলে তোমার সকল কার্য সিদ্ধ হবে।"
মাতার কাছে এই মন্ত্র নিয়ে বালক উপমন্যু ভগবান শিবের তপস্যা করবার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই ঋষি কুমার তখনই হিমালয় গমন করে কেবলমাত্র বায়ু ভক্ষণ করে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। আটটি ইট দ্বারা ঘর তৈরি করে এবং তাতে মাটির শিবলিঙ্গ স্থাপন করে ওই লিঙ্গে পার্বতী মহাদেবকে আহ্বান করলেন তারপর ভক্তিভরে 'নমঃ শিবায়' এই পঞ্চাক্ষর মন্ত্র জপ করতে করতে বনজ পুষ্প দ্বারা পুজো করে যেতে শুরু করলেন। কঠোর তপস্যায় উপমন্যুর শরীর কৃশ হয়ে গেল। এই সময় তাকে একা পেয়ে মরীচি দ্বারা অভিশপ্ত কতকগুলি পিশাচরূপী মুনি রাক্ষসভাববশত তার তপস্যার বিঘ্ন করতে লাগল। কিন্তু বালক উপমন্যু এই বিঘ্ন সত্ত্বেও তপস্যার অনুষ্ঠান করে যেতে থাকল। তিনি আর্তস্বরে উচ্চকণ্ঠে "নমঃ শিবায়" মন্ত্র উচ্চারণ করে যেতে লাগলেন। সেই মন্ত্র শব্দ শোনা মাত্র সেইসব পিশাচরূপী মুনিগণ রাক্ষস ভাব পরিত্যাগ করে সেই বালক তপস্বীর সেবা করে যেতে লাগলেন।
সেইসময় দেবগণ ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে ঋষিকুমার উপমন্যুর সমস্ত কথা জানালেন। দেবগণের সমস্ত কথা শুনে ভগবান বিষ্ণু ঘটনার কারণ জানতে পেরে মন্দর পর্বতে মহাদেবের কাছে গমন করে সেখানে মহাদেবকে বললেন, উপমন্যু নামের এক বালক দুগ্ধের জন্য তপস্যা করে এমনভাবে সব দগ্ধ করেছে যা সত্যি ভয়ের কারণ। তাকে নিবারণ করুন মহাদেব।
দেবাদিদেব মহাদেব ভগবান বিষ্ণুর কথা শুনে তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রের রূপ ধারণ করে তপস্যারত বালকের কাছে চলে গেলেন। তিনি ইন্দ্রের মত এক শ্বেত হস্তির উপর আরোহন করে সুর, অসুর ও সিদ্ধ গণের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হলেন। সেই ঋষি কুমার উপমন্যু তার শত্রুকে তার সামনে উপস্থিত দেখে ভূমি স্পর্শ করে তাকে প্রণাম করলেন। তারপর কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, "হে দেবেশ্বর আপনি যখন আমার আশ্রমে আগমন করেছেন তাতে আমার আশ্রম পবিত্র হল।” তখন ইন্দ্ররূপী মহাদেব উপমুন্যকে বললেন, হে মহামুনি তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট হয়েছি এখন বর প্রার্থনা করো। তুমি যে বর ইচ্ছা করবে আমি সেই বরই তোমাকে দান করব।
উপমন্যু তখন বললেন, আমি মহাদেবের প্রতি দৃঢ় ভক্তি ইচ্ছা করি এই বলে তিনি আবার তপস্যায় রত হলেন। ইন্দ্রের রূপ ধারী মহাদেব তখন উপমন্যু কঠোর তপস্যায় বিষয়ে জানতে পেরে তার ভক্তি বিষয়ক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য স্বয়ং নিজের নিন্দা করতে থাকলেন। মুনি বালক উপমন্যু ইন্দ্রের রূপ ধারনকারী মহাদেবকে চিনতে পারলেন না।
তিনি ভাবলেন দেবরাজ ইন্দ্রই মহাদেবের নিন্দা করছেন। তিনি তখন দুঃখিত হৃদয়ে বললেন, মহাদেবের নিন্দা যখন আমি শুনলাম তখন প্রাণ ত্যাগ করাই শ্রেয়। এই বলে তিনি প্রাণ ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। নিজের প্রাণ ত্যাগ করার আগে মহাদেবের নিন্দাকারী ইন্দ্রকে বধ করার জন্য অঘোর অস্ত্র অভিমন্ত্রিত করে ভস্মসহ ইন্দ্রের ওপর নিক্ষেপ করলেন তারপর নিজের দেহ দগ্ধ করার জন্য আগ্নেয়ী বা অগ্নিপাত্র ধারণ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তা দেখে মহাদেব তাকে নিয়ে নিবারণ করলেন। নন্দী মহাদেবের নির্দেশেই অঘোর অস্ত্র নিবারণ করলেন। এই সময় স্বর্গে দুন্দুভি বাজতে শুরু করলো। স্বর্গ থেকে বৃষ্টি হতে শুরু করলো। ব্রহ্মাসহ সকল দেবগনের আগমনে দশদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দেবাদিদেব মহাদেব নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। তখন উপমন্যুও আনন্দের সঙ্গে ভক্তিভরে মহাদেবকে প্রণাম করলেন।
মহাদেব তখন উপমন্যুকে দেখিয়ে পার্বতীকে বললেন, “এই তোমার পুত্র” দেবী তখন উপমন্যুর মাথায় সন্তানস্নেহে হাত রেখে তাকে অক্ষয় কুমার পদ প্রদান করলেন। এরপর দেবাদিদেব তাকে ক্ষীর সমুদ্র দান করলেন, সেই সময় কুবের ও প্রলয়কাল পর্যন্ত স্থায়ী ধন সম্পদ উপমন্যুকে দান করলেন। মহাদেব পাশুপাত ব্রত, জ্ঞান ও ব্রতযোগের তত্ত্ব, পাদুকাময় এবং সর্বঞ্জত্ব পদ দান করলেন।
শিব পুরাণের অষ্টাদশ অধ্যায়ে উল্লেখিত উপমুন্যর এই দৃঢ় শিব ভক্তি ও তপস্যার গল্প ভক্তিযুক্ত মনে পাঠ করলে দেবাদিদেবের চরণে ভক্তি ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়।