'মৎস্য পুরাণ'-এর একটি কাহিনিতে রয়েছে উমার 'গৌরী' হয়ে ওঠার কথা। সেখানে বলা হয়েছে, সতী দেহত্যাগ করে হিমালয়ের ঘরে মেয়ে হয়ে তো জন্মালেন, কিন্তু, তাঁর গায়ের রঙ হল ঘোর কালো। আর সেই কালো মেয়ের নাম হল, 'উমা'। তারপর উমা যখন বড় হলেন, তখন অনেক তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করে তাঁকে স্বামী হিসেবে পেলেন। কিন্তু, পছন্দের স্বামীকে বিয়ে করেও তাঁর মনে কোন শান্তি এলো না। তাঁর খালি মনে হতে লাগল, তিনি তো কালো, শিবের যদি কখনো কোন ফর্সা নারীকে ভালো লেগে যায়! তখন কী হবে! তখন তো তাঁর সাধের সংসারটি ভেসে যাবে! তাছাড়া শিব শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ানো লোক, তাঁর গুণেরও ঘাট নেই, তাঁকে যে চোখে চোখে রাখবেন তারও তো উপায় নেই! তাহলে?
অনেক ভেবেচিন্তে উমা একটি উপায় বের করলেন। তিনি মন থেকে সৃষ্টি করলেন এক পুত্রকে। তার নাম দিলেন, 'বীরক'। তাকে দিলেন অহর্নিশ শিবকে চোখে চোখে পাহারা দেওয়ার কাজ। মায়ের আদেশে বীরক সোনার লাঠি নিয়ে ছুটলেন শিবলোক পাহারা দিতে। তাই দেখে, তবে যেন নিশ্চিন্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন উমা। যাক, এতদিনে একটা কাজের কাজ হল!
সেদিন শিব আর উমা বসে দাম্পত্যালাপ করছিলেন। হঠাৎ শিবের একটু দুষ্টুমি করার সাধ হল, কথার প্যাঁচে উমাকে বলে বসলেন, 'কালো'! ব্যস, আর যায় কোথায়! উমা বুঝলেন না সুঝলেন, তিরিক্ষে হয়ে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। যার যেখানে ব্যথা, সেখানে খোঁচা দিলে কারই বা মাথার ঠিক থাকে! ফলে, তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন! রি রি করে শুনিয়ে দিলেন বেশ দু'চার কথা : মহাদেবও তো মহাকালরূপে ঘুটঘুটে কালো, তাহলে তাঁকে খোঁচা দিয়ে 'কালো' বললেন কেন!
শিব উমাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু, উমা তাতে আরও রেগে গিয়ে মহাদর্পে শিবলোক ছেড়ে চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, যতক্ষণ না গায়ের রঙ ফর্সা হচ্ছে, ততক্ষণ তপস্যা করবেন। গায়ের রঙ নিয়ে কথা যখন উঠেছে, তখন এসপার-ওসপার কিছু একটা না-করে কিছুতেই ফিরবেন না। তবে, বাধ্য বীরক যেন এ-সময়টা মহাদেবকে চোখে চোখে রাখে--যাবার আগে রাগের মাথাতেও সে-কথা বলতে ভুললেন না উমা।
শিবলোক ছাড়িয়ে রাগে হনহন করে হেঁটে চলেছেন উমা। পথে মায়ের সঙ্গে দেখা হল, বাবার সঙ্গে দেখা হল। জানালেন তাঁদের জামাইয়ের 'কালো'-বলে খোঁটা দেওয়ার বৃত্তান্ত। শুনে তাঁরা খানিক 'ছিঃছিঃ' করলেও জামাইকে একেবারে হতচ্ছেদ্দা করতে পারলেন না। যতই হোক, যেমনই হোক, স্বামী তো! বোঝাবার চেষ্টা করলেন, সংসারে থাকতে হলে সকলকেই একটু ক্ষমাঘেন্না করে থাকতে হয়। কিন্তু, কে শোনে কার কথা! উমা তখন রাগে জ্বলছেন। বাপ-মার সামনেও আর তিষ্ঠোতে ইচ্ছে হল না। তাঁদের ছাড়িয়ে হনহন করে ফের হাঁটা দিলেন। তারপর এক নির্জন স্থানে গিয়ে শুরু করলেন ঘোর তপস্যা। কখনও সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপের মাঝে নিজের চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে, কখনও বা দারুণ শীতে জলের তলায় বসে চলতে লাগল তাঁর মারাত্মক কৃচ্ছসাধনা।
এদিকে আর এক কাণ্ডের সলতে পাকানো তখন শুরু হয়ে গেছে। বেশকিছু কাল আগে 'অন্ধক'- নামের এক দৈত্যকে শিব নিজের হাতে বধ করেছিলেন। তার ছেলে 'আড়ি' এখন বড় হয়েছে। সে এতদিন তক্কে তক্কে ছিল, এবার শিবকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করল। দীর্ঘ তপস্যার শেষে যথারীতি একখানা বরও বাগিয়ে নিল সে। অমরত্ব তো মিলবে না, তাই কায়দা করে বর চাইল যে, সে ইচ্ছে করলেই যেন কোন কিছুর রূপ ধারণ করতে পারে। ব্রহ্মা তাকে রূপ-পরিবর্তনের বর দিলেন বটে, কিন্তু, সেইসঙ্গে এও বললেন যে, কোন কাজে একবারের বেশি রূপ-পরিবর্তন করলেই তার মৃত্যু হবে। বরে একটা 'কিন্তু' রইলেও এর সাহায্যে ছলেবলে শিবকে হত্যা করবে ভেবে আড়ির খুশির আর অন্ত রইল না।
উমা শিবকে ছেড়ে চলে গেছেন--এই খবর যখন আড়ির কাছে পৌঁছল, তখন সে দারুণ খুশি হল। ভাবল, উমার বিরহে শিব নিশ্চয়ই এখন আধমরা হয়ে গেছেন! তাহলে, এই হচ্ছে সুযোগ। মারতে হলে, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা এখনই মারতে হবে! অমনি সে হাজির হল শিবলোকের চৌহদ্দিতে। বীরকের চোখ এড়িয়ে সুতো-সরু কালো সাপের রূপ ধরে সে চুপি চুপি শিবলোকের ভেতরে ঢুকে পড়ল। বীরককে ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পেরে তার আনন্দের আর সীমা রইল না। সেই আনন্দের চোটে ভেবে বসল শিবকে মারার আগে একটু ল্যাজে খেলিয়েই মারবে! তাতেই সে ভুলে গেল দ্বিতীয়বার রূপ পরিবর্তনে ব্রহ্মার বারণের কথা। ধারণ করে বসল কালো উমার রূপ। তারপর ঢঙ করে ছলাকলায় কাত করতে উমার আদব নিয়ে শিবের কাছে হাজির হল। শিবের ধ্যান ভাঙাল। ধ্যান ভেঙে শিব সামনে কালো উমাকে দেখে প্রথমটায় খুবই অবাক হলেন। উমা যে-রকম জেদি, তাতে তপস্যা পূর্ণ না-করে তো ফেরার কথা নয়! তাহলে? এ-কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তাঁর চোখ গেল উমার গালের দিকে। কই সেখানে পরিচিত পদ্মচিহ্ন তো নেই! পরিবর্তে, ঘন লোমের আবর্ত! বুঝলেন, এ-উমা মায়া-উমা, মায়াবীর মায়া ছাড়া কিছুই নয়। ব্যস, বেশ জায়গা মতো ছাড়লেন এক রাম ঘুষি। আর সেই ঘুষিতেই একটা মরণ ডাক ছেড়ে স্বমূর্তি ধরে পট করে আড়ি মরে গেল।
এদিকে ঘটল আর এক কাণ্ড। আড়ি যখন উমার রূপ ধরে শিবের দিকে ঢঙ করে এগোচ্ছিল, তখন পবনদেব পিছন থেকে তাকে দেখে ফেললেন। আর দেখেই ভাবলেন, শিব নিশ্চয় সুযোগ বুঝে পরকীয়ার জন্য কোন সুন্দরী নারীকে ডেকেছেন! যেই না ভাবা, অমনি ছুটলেন তপস্যারত উমাকে খবর দিতে। আর এ-খবর পেতেই উমা তো একেবারে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। রাগে তাঁর নাকের পাটা ফুলতে লাগল। বেরিয়ে এলো এক নিদারুণ দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এলো তীব্র এক আগুনের গোলা। মুহূর্তে সেই গোলা হয়ে উঠল আকাশব্যাপী অগ্নিময় সিংহ। প্রচণ্ড রাগে সেও জগৎব্যাপী হাঁ বিস্তার করে গর্জন করে উঠল। স্বামীর দুরাচারের অভিমানে সিংহের সেই প্রকাণ্ড হাঁ-মুখের মধ্যে প্রবেশ করে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলেন উমা। কিন্তু, তাতে বাদ সাধলেন এসে ব্রহ্মা। তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিবৃত্ত করে উমাকে বর দিতে চাইলেন। তখন উমা ব্রহ্মার কাছে চাইলেন তাঁর চিরকাঙ্ক্ষিত ফর্সা হওয়ার বর। ব্রহ্মা 'তথাস্তু' বলতেই মুহূর্তে উমার শরীর থেকে কালো আবরণ খুলে পড়ল, দেহ হয়ে উঠল উজ্জ্বল গৌর কাঞ্চনবর্ণ। তখন ব্রহ্মা প্রথম তাঁকে 'গৌরী' বলে সম্বোধন করলেন। এখান থেকেই উমার আর এক নাম হয়ে গেল, 'গৌরী'। উমার শরীরবিচ্যুত কালো আবরণ থেকে আর এক দেবীর সৃষ্টি হল, ব্রহ্মা তাঁর নাম দিলেন, 'একেশ্বরী'। ব্রহ্মা সেই দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত সিংহটিকে তাঁর বাহন করে দিলেন। পরবর্তীকালে উমা যখন মহিষাসুর বধের জন্য 'মহিষাসুরমর্দিনী' রূপ ধারণ করলেন, তখন এই সিংহটি তাঁরই বাহন হয়ে উঠল।
যাই হোক, গৌরবর্ণা 'গৌরী' হয়ে উমা যার পর নাই আনন্দিত হয়ে ভুলেই গিয়েছিলেন শিবের অন্যায় পরকীয়ার কথা। এখন সেটা মনে পড়তেই তাঁর আবার মাথা গরম হয়ে গেল এবং অমনি তেড়েফুঁড়ে শিবলোকে ছুটলেন একটা হেস্তনেস্ত করতে। কিন্তু, গিয়ে যখন দেখলেন আড়ি রাক্ষস মরে পড়ে আছে এবং শিবের কাছে শুনলেন আসল বৃত্তান্ত; তখন মিথ্যে ক্রোধের জন্য ও মহাদেবের প্রতি মিথ্যে সন্দেহের জন্য তিনি লজ্জিত হলেন। শিবও 'কালো' বলে উমাকে খোঁটা দিয়ে যে অন্যায় করেছিলেন, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। ফলে, শেষটা আর পাঁচটা সহজ দাম্পত্যজীবনের মতোই বেশ মিলনান্তক হয়ে উঠল।