শীত মানেই, পেয়াঁজ চাষের সময়। এই সময় আমরা চাষ করবো ছাঁচি পেঁয়াজের। ছাঁচি পেঁয়াজ--একসঙ্গে অনেকগুলো কোয়া গায়ে মাখামাখি হয়ে থাকে। খোসা তার খুব পাতলা। সেটা ছাড়িয়ে মুসুর ডাল সাঁতলানোর সময় তাতে দিন না একমুঠো, অথবা সরষে বা পোস্ত দিয়ে চচ্চড়ি করুন; পরিমাণমতো নুন দিয়ে জিরে, শুকনো লঙ্কা আর ছাঁচি পেঁয়াজের কোয়া একসঙ্গে ভেজে তাতে ভাতেসেদ্ধ আলু মাখুন--পাবেন অসাধারণ টেস্ট। ছাঁচি দেখতে ছোট, কিন্তু স্বাদে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে এমন পেঁয়াজ কোত্থাও নেই। এ যাঁরা খেয়েছেন, তাঁরাই জানেন; যাঁরা খাবেন, তাঁরাই জানবেন।
এই পেঁয়াজ ওঠে মাঘ-ফাল্গুন নাগাদ। সেই সময় শহরের রাস্তায়, সবজির বাজারে সব্জিওয়ালা একশ গ্রাম পেঁয়াজের দর হাঁকে কুড়ি থেকে চল্লিশ; যে যেমন পারে! ফলে ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময়ই এ পেঁয়াজ যথেচ্ছ খাওয়ার সামর্থ্য আমাদের অনেকেরই থাকে না। কিংবা সামর্থ্য থাকলেও ওই দামে অন্য কিছু খাওয়ার বাসনা জাগে। আসলে সত্যি বলতে কী, অত দাম দিয়ে পোষায় না।
অত কেনাকেনি, দামাদামির মধ্যে যাবারই দরকার নেই। অত্যন্ত সহজেই এই পেয়াঁজ ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে চাষ করে নেওয়া যায়। কীভাবে সেটাই এখন বলছি:
আমি বিগত তিন বছর ধরে আমার ছাদবাগানে এই পেঁয়াজ চাষ করে আসছি। এই লেখার সঙ্গে যে ছবিগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, তা সেই চাষেরই নমুনা। আমি চাষ করি এক কেজির পলিব্যাগে। তাতে চমৎকার চাষ করা যায়। সারাবছর যে পলিব্যাগগুলো মুদিখানা বা অন্যান্য বাজারসূত্রে বাড়িতে আসে, সে-সব আমি পেঁয়াজ চাষের জন্য জমিয়ে রাখি। পলিব্যাগে চমৎকার পেঁয়াজ চাষ করা যায়। আপনি আমার মতো করে পলিব্যাগ সংগ্রহ করতে করতে পারেন। অথবা পলিব্যাগের দোকান থেকেও কিনে নিতে পারেন। কুড়ি-পঁচিশ টাকায় দুশো-আড়াইশো গ্রাম পলিব্যাগ পেয়ে যাবেন। এতে মোটামুটি পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটা ব্যাগ পাওয়া যায়।
আপনার বাগানে যদি কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা রোদ আসে তাহলে চিন্তা নেই। তাতে পেঁয়াজ বেশ ভালোভাবে চাষ করা যাবে। পেঁয়াজ গাছ শক্তপোক্ত হতে, পেয়াঁজ পাতা বলিষ্ঠ হতে, পেঁয়াজের কোয়া পুষ্ট হতে এই রোদটুকু লাগে। এর চেয়ে বেশি সময় ধরে রোদ পেলে আরও ভালো। এক থেকে দেড় ঘন্টা রোদ পেলেও পেয়াঁজ গাছ হবে, কিন্তু পাতা বলিষ্ঠ হবে না, কোয়াও দানা বাঁধবে না। আপনার বাগানে যদি এটুকু রোদ আসে, তাহলে পেয়াঁজের পাতা শাক হিসেবে পেতে আপনি চাষ করতেই পারেন। কম রোদ পেলে পেঁয়াজ গাছ অসংখ্য দুর্বল পাতার জন্ম দেয়।
বাজারে চাঁছি পেঁয়াজের বীজ হিসেবে চাঁছি পেঁয়াজই পাবেন। এগুলো কিনতে পাওয়া যায় যেকোন কৃষিবীজ বিক্রেতার দোকানে। শহরতলি থেকে আপনাকে এগুলো সংগ্রহ করতে হবে। স্থানীয় গাছবিক্রেতা বা নার্সারিতে বললে হয়তো এনে দিতে পারে। শহরতলি থেকে রান্না বা গৃহকর্মসহায়িকার জন্য যাঁরা প্রতিদিন শহরে আসেন, তাঁদের দিয়েও আনিয়ে নেওয়া যেতে পারে। মোটকথা, শহরতলিতে এই বীজ সহজলভ্য এবং সস্তাও। সেখানে স্থানবিশেষে ছাঁচি পেয়াঁজের বীজের দাম কেজিতে দেড়শ থেকে দুশো টাকা পড়ে। আপনার দুশো থেকে আড়াইশো গ্রাম বীজ হলেই হবে। তাতেই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটা পলিব্যাগে আরামসে লাগানো যাবে।
ছবিঃ নিজস্ব চিত্র
আমি ছাঁচি পেঁয়াজের জন্য বেলে মাটি তৈরি করি। এতে ফলন ভালো হয়। মাটি সহজে আলগা রাখা যায়। পেয়াঁজের কোয়া পুষ্ট হওয়ার জন্য মাটি আলগা রাখা খুবই জরুরি। তাছাড়া গাছের গোড়ায় জমা জল পেঁয়াজের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। তাই দেখতে হবে যাতে গোড়ায় জল যেন একেবারেই না-জমে। সেদিক থেকে বেলেমাটি খুবই কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এই মাটি তৈরি করতে দু'ভাগ মোটা বালি, এক ভাগ সরু বালি, এক ভাগ এঁটেল মাটি আর এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা পুরোনো গোবর সার ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে মেশাতে হবে। তারপর প্রতিটি পলিব্যাগে এই মাটি ভরতে হবে। পলিব্যাগের হাতল যেখানে শুরু তার নীচের দিকে দুই থেকে তিন ইঞ্চি অংশ ফাঁকা রাখতে হবে। হাতল ও ফাঁকা অংশের পলিথিন ফুলহাতা জামার হাতা যেভাবে গোটানো হয়, সেভাবে বাইরের দিকে গুটিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি পলিব্যাগের তলায় চারদিকে পাশাপাশি দুটো করে আটটা ফুটো করতে হবে। এক্ষেত্রে ফুটো করার জন্য কালি শেষ হয়ে যাওয়া ইউজ এন্ড থ্রো জেল পেন ব্যবহার করবেন।
যে পেয়াঁজবীজগুলো কিনে এনেছেন, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো গায়ে গায়ে লেগে আছে, তাদের আলাদা করতে হবে। মানে, বীজ বসানোর জন্য প্রতিটি কোয়া আলাদা করতে হবে। এদের মধ্যে দেখবেন কিছু কোয়া খুব হৃষ্টপুষ্ট, কিছু কোয়া খুব দুর্বল। পুষ্ট কোয়া থেকে বলিষ্ঠ গাছ হবে, দুর্বল কোয়া থেকে গাছও দুর্বল হবে। আমরা প্রতিটি প্যাকেটের চারটে দিকে একটা করে চারটে কোয়া পুঁতে দেব। প্লাস চিহ্নের প্যাটার্নে এ মাথায়-ও মাথায় একটা করে সবল বীজ; উল্টোদিকে দুটো দুর্বল বীজ আমরা পুঁতব। প্রতিটি বীজ মাটির হাফ ইঞ্চি নীচে পোঁতা হবে। মাটিতে বীজ পুঁতে জল স্প্রে করে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। বীজ বসানোর পর প্রতিটি পলিব্যাগ থাকবে রোদযুক্ত নির্দিষ্ট স্থানেই। একমাত্র জল শুকোলে, তবেই জল দিতে হবে। এই নিয়ম বীজ অবস্থা থেকে ফসল ওঠা পর্যন্ত চলবে।
বীজ পোঁতার চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই মাটি ভেদ করে নতুন গাছ বেরিয়ে আসবে। চারটে পাতা ছাড়ার পর থেকেই খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। এক সপ্তাহের শুরুতে তিনদিনের খোলপচা জল পাতলা করে দিলেন তো, পরের সপ্তাহের শুরুতে পনেরো দিনের সবজি পচা জল পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি কুড়ি দিন অন্তর আট চামচ সিঙ্গল সুপার ফসফেট গুঁড়ো, দু'চামচ পটাশ, এক চামচ ইউরিয়া একসঙ্গে মিশিয়ে এক চা-চামচ করে প্রতিটি পলিব্যাগের কিনারার মাটিতে গাছের থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে মিশিয়ে দিতে হবে। এই রুটিনে খাবার দেওয়া চলবে।
সিঙ্গল সুপার ফসফেট গুঁড়ো প্রতি কেজির দাম ছাব্বিশ টাকা, পটাশ প্রতি কেজির দাম বারো টাকা, ইউরিয়ার কেজি প্রতি দাম দশ টাকা। সবগুলো পরিমাণমতো কিনে এনে আলাদা আলাদা পলিথিনে রেখে বাতাস যাতে না-ঢুকতে পারে, এমনভাবে মুখ বেঁধে রেখে দেবেন কোন শুকনো জায়গায়। দীর্ঘদিন ভালো থাকবে, ব্যবহার করা যাবে। এর সঙ্গে দুশো গ্রাম সালফার কিনে এনে রেখে দেবেন। নব্বই টাকা কেজি। পেঁয়াজ গাছের পাতা ডগা সাদা হয়ে তা ক্রমশ নীচ অব্দি ছড়িয়ে পাতা নেতিয়ে যাচ্ছে দেখলেই সেই পলিথিনে তিন থেকে চার দানা সালফার দিয়ে দেবেন। ব্যস, আর কোন ঝামেলা থাকবে না। এর সঙ্গে নিয়মিত স্টিলের কাঁটাচামচ দিয়ে সাবধানে পলিব্যাগের মাটি আলগা করে দেবেন। আর আগাছা দেখলেই ধ্বংস করবেন। এর বেশি পেয়াঁজের পরিচর্যায় তেমন কিছু করতে হবে না।
মাসখানেকের মধ্যেই পেঁয়াজ গাছ অনেক পাতা ছড়াবে, ঝাড় কাটতেও শুরু করবে। এই সময় থেকে আমরা পলিব্যাগের দুর্বল গাছগুলোকে তুলে সবজি হিসেবে খাওয়া শুরু করব। এভাবে আমরা প্রতিটি পলিব্যাগে এক থেকে দুটি সতেজ গাছ রাখব; বাকিগুলো তুলে নেব। এবং অচিরেই দেখব সেই একটি বা দুটি গাছ ঝাড়ে বাড়তে বাড়তে পলিব্যাগ ভরিয়ে ফেলছে। যত ঝাড় বাড়বে, তত কোয়ার সংখ্যা বাড়বে। এগুলোকে আমরা আর কিছুতেই ডিস্টার্ব করব না।
গাছের যৌবনদশায় প্রতিটি কোয়া থেকে একটি করে কলিওয়ালা দণ্ড উঠতে শুরু করবে। এগুলো ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি দণ্ড ভেঙে ফেলতে হবে। এগুলো ভেজে ও পদ রেঁধে খাওয়া যায়। খুব সুস্বাদু। কিন্তু এদের বেশি বাড়তে দিলে বা ফুল ফুটতে দিলে সমস্ত পুষ্টি নিজেরা খেয়ে নিয়ে কোয়াদের হৃষ্টপুষ্ট হতে দেবে না।
যাই হোক, মাস তিন-চার এই সব পরিচর্যার মধ্য দিয়ে কাটানোর পর যখন দেখবেন যে, গাছগুলোর পাতা ধীরে ধীরে হলুদ হচ্ছে, তখন সঅব ধরণের খাবার দেওয়া একেবারে বন্ধ করে দেবেন। মাটি শুকোলে শুধুমাত্র জল দিতে থাকবেন। এর মধ্যদিয়ে যখন গাছগুলো পুরোপুরি মরে যাবে, তখন মাটি থেকে গাছশুদ্ধু কোয়াদের তুলে নেবেন। এভাবে চাষ করলে দেখবেন, এক-একটা পলিব্যাগ থেকে আপনি দেড়শ থেকে দুশোগ্রাম পেঁয়াজ ফলাতে পারবেন।
রয়ে-সয়ে এসব পেঁয়াজ যদি খেতে চান, তাহলে পেঁয়াজ থেকে গাছগুলো কেটে ফেলে দেবেন না। গাছশুদ্ধু পেয়াঁজগুলো আঁটি বেঁধে ঘরেই কোথাও ঝুলিয়ে রাখবেন। তা থেকেই প্রয়োজনমতো তুলে তুলে ব্যবহার করবেন। এতে পেঁয়াজেরা অনেকদিন তাজা থাকে।