অপরূপ সৌন্দর্যে জারবেরা আমাদের যতটা মোহিত করে, ঠিক ততটাই আমোদিত করে গ্যাজেনিয়া। তার যেমন রূপ, তেমন রঙ, তেমনি বাহার। একবার যদি কেউ এ-ফুলের প্রেমে পড়ে আপন বাগানে চাষ করতে শুরু করেন, আজীবন তাঁর সেই প্রেম থেকে মুক্তি নেই; ফি-বছর তিনি এই ফুল চাষ করবেনই করবেন। সবচেয়ে বড় সুবিধের কথা, খানিক যত্ন নিলে একবার চাষ করে কয়েক বছর একই গাছ থেকে ফুল পাওয়া যায়। এবং, বীজ ছাড়াই একটি গাছ থেকে পরের বছরের জন্য বেশ কয়েকটি নতুন গাছ তৈরি করে নেওয়া যায়। কীভাবে? সেটাই এখন বলছিঃ
আপনার ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে যদি কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা বেশ ভালো শীতের রোদ আসে, তাহলেই গ্যাজেনিয়া ফুল চাষ করুন, নতুবা নয়। এর চেয়ে কম রোদে অর্থাৎ তিন-চার ঘন্টার রোদেও এই ফুলের গাছ হবে, কিন্তু গাছের স্বাস্থ্য ভালো হবে না, ফুলও ভালো পাওয়া যাবে না। কেননা, গ্যাজেনিয়া শীতের রোদ খুব ভালোবাসে। এই গাছের ফুল যতক্ষণ রোদ বা দিনের আলো থাকে, ততক্ষণ পাঁপড়ি খুলে রাখে; রাত্তিরে ফুল বুজে যায়; আবার দিনের আলোয় ময়ূর পুচ্ছের মতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে পাঁপড়ি মেলে। এভাবেই ফুলগুলো বেশ কয়েকদিন বাগানের শোভা হয়ে বেঁচে থাকে।
গ্যাজেনিয়া ফুলে রঙে প্রচুর ভ্যারাইটি। এক রঙা ফুল, দুই রঙা ফুল, একাধিক রঙের নকশাওয়ালা ফুল—ফুলে কত রকমের তার বাহার। তবে পাঁপড়ির সংখ্যার দিক থেকে এই ফুল মূলত দুই রকমের, সিঙ্গল পেটাল ও ডাবল পেটাল।
গ্যাজেনিয়া ফুলের চারা রোপণের সঠিক সময় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। এখন যেহেতু জানুয়ারি পড়ে গেল, ছোট চারা এনে চাষ করার আর সময় নেই। পাড়ার নার্সারি বা গাছওয়ালার কাছ থেকে এখন একটু বড় অর্থাৎ ‘তৈরি’ গাছ নিয়ে আসুন। সবুজ, সতেজ ও স্বাস্থ্যবান এবং কুঁড়ি এসেছে বা আসতে চলেছে, সেই সঙ্গে কালো পলিব্যাগে বসানো আছে—এমন গাছই এখন চাষের জন্য কিনে আনুন। যে অবস্থাতে তাকে কিনে এনেছেন, সেই অবস্থাতেই তাকে বেশ আলোযুক্ত স্থানে রেখে দিন দিন-দশেক; আপনার বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে তাকে এভাবেই মানিয়ে নিতে দিন। তারপর তাকে রি-পটিং-এর আয়োজন শুরু করুন।
গ্যাজেনিয়া রোদ ভালোবাসে, কিন্তু অতিরিক্ত জল বা গোড়ায় জল জমা একেবারেই পছন্দ করে না। তাই এই গাছের জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি একেবারে আদর্শ। এই মাটি জল ধরে রাখে না। গাছের গোড়ায় জল জমলে এই গাছে ছত্রাকের আক্রমণ হয়ে গোড়া পচে যায় এবং গাছ মারা যায়। দু’একদিনের বৃষ্টিতে কিচ্ছু হয় না, টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে এই গাছ শেডে চালান করতে হয়। প্রথম থেকেই এই গাছে জল দেওয়ার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মাটিতে রস থাকলে জল দেওয়া যাবে না, মাটি শুকিয়ে এলে তবেই জল দেবেন।
যাই হোক, গ্যাজেনিয়া রি-পটিং-এর জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি তৈরি করতে হবে। তার জন্য চল্লিশ শতাংশ এঁটেল মাটির সঙ্গে চল্লিশ শতাংশ বালি এবং কুড়ি শতাংশ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার ভালোভাবে মিশিয়ে ঝুরঝুরে অবস্থায় নিয়ে আসুন, তাহলেই হবে। তারপর আট ইঞ্চি (এই গাছ যেহেতু ঝাড়ে বাড়ে, তাই দশ থেকে বারো ইঞ্চি টব এই ইঞ্চি টব সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চাষ করলে ব্যবহার করা হয়, এখন চাষ করতে আট ইঞ্চি টব হলেও হবে।) টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে তলায় অল্পকিছু মাটি দিয়ে তার ওপর এপসম সল্ট (এটি গাছকে রি-পটিং-এর শক থেকে বাঁচায়, সতেজ রাখে) এক চামচ পাতলা করে ছড়িয়ে দিন; এবার খুব সাবধানে কালো পলিব্যাগ থেকে মাটিশুদ্ধ গাছটি বের করে এনে টবের ঠিক মধ্যিখানে বসিয়ে দিন। তারপর চারপাশ তৈরি মাটি দিয়ে ভরাট করে বেশ ভালোভাবে চেপে চেপে মাটিগুলো বসিয়ে দিন। এবার গাছের গোড়ায় জল দিয়ে টবশুদ্ধ গাছটি তিনদিন শেডে রেখে চতুর্থ দিন ফুল সানলাইটে দিন।
রি-পটিং-এর এক সপ্তাহ পর থেকে গাছে খাবার দেওয়া শুরু করবেন। খাবার দেওয়া ও পরিচর্যার কয়েকটি ধাপ আছে; সেগুলো হলঃ
ক. প্রতি সপ্তাহে একদিন তিনদিনের সরষের খোলপচা জল বা একদিনের বাদামখোল পচানো জল দিতে হবে। এক্ষেত্রে এক মগ সরষে বা বাদাম খোলপচা জলের সঙ্গে আরও দশ মগ সাধারণ জল মিশিয়ে পাতলা করে তবেই গাছে দেবেন।
অথবা,
সরষে খোল পাঁচদিন ভিজিয়ে তাতে এক চামচ ডিএপি সার মিশিয়ে আরও দু’দিন পচাতে হবে; তারপর এক মগ এই মিশ্রিত জলের সঙ্গে আরও দশ মগ সাধারণ জলের সঙ্গে মিশিয়ে সপ্তাহে একবার গাছে দিতে হবে।
অথবা,
উনিশঃউনিশঃউনিশ, কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি, দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ—এই এনপিকে রাসায়নিক সার গুলোর যে-কোন একটা প্রতি পনেরো দিন অন্তর টব প্রতি এক চা-চামচ করে টবের ভেজা মাটিতে গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
(তিনটের মধ্যে যে-কোন একটি পদ্ধতি মেনে খাবার দিলেই হবে।)
ঘ. প্রতি পনেরো দিন অন্তর অনুখাদ্য এক লিটার জলে দু’গ্রাম পরিমাণে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। এই সার নিয়মিত দিলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, গাছ ও ফুলের চকচকে ভাব বজায় থাকবে এবং গাছ বেশি ফুল দেবে।
ঙ. গাছ যদি ঝাড়ে কম বাড়ছে মনে হয়, তাহলে পনেরো দিন অন্তর টবপ্রতি এক চা-চামচ ফসফেট দিন একমাস।
চ. পর্যাপ্ত ফুল পাচ্ছেন না, এমন অবস্থা হলে, পনেরো দিন অন্তর আধ চা-চামচ পটাশ টব প্রতি দিতে থাকুন, যতদিন না বাঞ্ছিত ফুল পাচ্ছেন। এর সঙ্গে মিরাকুলান-এর মতো পুষ্টিমৌল এক লিটার জলে পঁচিশ থেকে তিরিশ ফোঁটা মিশিয়ে স্প্রে করুন প্রতি দশদিন অন্তর সকালে।
ছ. গ্যাজেনিয়ায় যেহেতু জল দেওয়ায় একটু এদিক-ওদিক হলেই ছত্রাকের আক্রমণ হয়, তাই দশদিন বা পনেরো দিন অন্তর এক লিটার জলে দু’গ্রাম ছত্রাকনাশক মিশিয়ে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
গ্যাজেনিয়া গ্রীষ্মের রোদ সহ্য করতে পারে না। তাই শীত শেষ হয়ে এলে গ্যাজেনিয়ার টবগুলো সেমিশেডে রাখার ব্যবস্থা করুন। ছায়ায় রাখলে এবং ভালোভাবে পরিচর্যা করলে এই গাছ জুন মাস পর্যন্ত ফুল দেবে। গাছও বেশ সুস্থ থাকবে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে রেখে দিলে গাছ ফুল তো দেয়ই না, উপরন্তু গাছ রোদে পুড়ে মারা যায়। এই গাছ যেহেতু প্রচুর বৃষ্টি ভালোবাসে না, তাই বর্ষাতেও এই গাছের টবগুলো শেডে রাখবেন। একই গাছ থেকে পরের বছর ফুল পেতে এটুকু তো করতেই হবে।
গ্যাজেনিয়া ফুল থেকে বীজ পাওয়া যায়, তা সংগ্রহ করে রেখে দিয়ে বর্ষার শেষে বীজ থেকে চারা করে আপনি পরের বছর নতুন গাছ করতে পারেন। তাছাড়া পুরনো গাছ থেকেও অল্প আয়াসে অনেক নতুন গাছ তৈরি করে নিতে পারেন। কীভাবে? বলছিঃ
রজনীগন্ধা যেভাবে নতুন কন্দ তৈরি করে গাছ বাড়িয়ে ঝাড়ে বাড়ে, গ্যাজেনিয়া গাছ কতকটা সেভাবেই গোড়ায় গায়ে গায়ে অনেকগুলো গাছ তৈরি করে ঝাঁকড়া হয়ে ওঠে। এই গাছগুলোকে আলাদা করে প্রতিস্থাপন করলেই এক-একটি ঝাড় থেকে দশ-বারোটা করে নতুন গাছ পাওয়া যাবে। বর্ষার ঠিক আগে, প্রথমে পুরনো গাছগুলো টব থেকে তুলে এই গাছগুলো আলাদা করে নিতে হবে। তারপর তাদের নষ্ট ও পুরনো পাতাগুলো ছেঁটে দিতে হবে। এরপর দেড়-দু’ইঞ্চি পট বা প্লাস্টিকের ইউজ এন্ড থ্রো গেলাসের তলায় ফুটো করে ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করে নিতে হবে। তারপর এই পট বা গেলাসে নতুন করে তৈরি করা বেলে-দোআঁশ মাটি দিয়ে তাতে এক-একটি গাছ বসিয়ে দিতে হবে। শেডের নীচে পরিমাণমতো জল, খাবার ও পরিচর্যা পেলেই অল্পদিনে এই গাছগুলো নতুন করে পাতা ছড়াবে। এভাবেই বর্ষার শেষে এই গাছগুলো আবার রি-পটিং-এর জন্য তৈরি হয়ে যাবে।
তখন তৈরি করতে হবে গ্যাজেনিয়ার জন্য আদর্শ মাটি। মাটি, বালি ও গোবর বা ভার্মি কম্পোস্টের পরিমাণ আগের মতোই রেখে প্রতি টবের হিসেবে এর সঙ্গে এক চামচ হাড়গুঁড়ো, এক চামচ নিমখোল, আধ চামচ ডিএপি ভালো করে মিশিয়ে জল দিয়ে দিতে হবে। কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন এই মাটি রোদে পড়ে থাকবে, শুকোলেই কুপিয়ে জল দিতে হবে। কুড়ি-পঁচিশ দিনের মাথায় মাটি একেবারে শুকিয়ে ঝুরঝুরে করে টবে ভরে আগের পদ্ধতিতে গাছগুলো রি-পটিং করে ফেলতে হবে। এভাবে মাটি তৈরি করে আপনি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাজার থেকে থাম্বপটে তৈরি নতুন চারা কিনেও রোপণ করতে পারেন। তারপর ধাপে ধাপে বলা পরিচর্যাগুলো ফলো করলেই পুরনো হোক বা নতুন, অঢেল গ্যাজেনিয়ার অফুরন্ত বাহারে আপনার সাধের বাগান সেজে উঠবে।...