বেগুনি টগরঃ সঠিক পরিচর্যা পেলে এই গাছ সারা বছর প্রচুর ফুল দেয়

অত্যন্ত অল্প পরিচর্যায় সাধের ছাদ বা ব্যালকনি বাগান সারা বছর সাজিয়ে রাখতে চান? তাহলে, আপনাকে অবশ্যই পাঁচ-পাঁপড়িওয়ালা ‘স্টার ফুল’ বা ‘তারা ফুল’ চাষ করতে হবে। এই ফুলকে বাংলায় কেউ বলেন ‘নীল টগর’, কেউ বা বলেন ‘বেগুনি টগর’। আমি ‘বেগুনি টগর’ই বলি। কেননা, আমার চোখে এই গাছের ফুলের রঙ বেগুনি। এই গাছের ফুল দেখতে সুন্দর, থোকায় ফোটে। প্রতিটি থোকায় তিন-চারটি কুঁড়ি, তাদের বিন্যাসটিও অতীব সুন্দর। ফুলগুলি বেশ উজ্জ্বল রঙের। পাতাতেও সবুজের মাঝে বেগুনি আভা। সব মিলিয়ে এই গাছ বাগান আলো করে রাখে। শীতে ফুলের পরিমাণ সামান্য কমে। অন্যান্য সময় তেড়ে ফুল দেয় এই গাছ। মোট কথা, বছরের কোন সময়ই এই গাছ ফুল দেওয়া বন্ধ করে না। তাই বর্তমানে সাধের ছাদ বা ব্যালকনি-বাগানিদের মধ্যে এই ফুল গাছ চাষ করার একটা ব্যাপক প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আসুন, এবার এই গাছ করতে হলে কোন কোন দিক খেয়াল রাখতে হবে, জেনে নিইঃ 

মাটি ও জলের ব্যবস্থাপনা

বেগুনি টগর গোড়ায় জল জমা যেমন পছন্দ করে না, তেমনি মাটি খটখটে শুকনো হয়ে যাবে—এটাও পছন্দ করে না। তাই সারা বছর এর টবে জল দেওয়ার সময় এ-কথা মনে রাখবেন। খেয়াল রাখবেন, এর মাটি সবসময়ই সামান্য স্যাঁতসেঁতে যেন থাকে। এবার এই ধরণের মাটি তৈরি করতে হলে এক ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে, এক ভাগ সমান পরিমাণে মেশানো হলদেটে মোটা বালি ও মিহি সাদা বালি, এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার কিংবা পাতাপচা সার ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে মেশাতে হবে। অথবা, পুরনো টবে ব্যবহৃত অথচ ফেলে দেওয়া দোআঁশ মাটির সঙ্গে সমান পরিমাণে ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার কিংবা পাতাপচা সার বেশ ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেও হবে। এবার স্যাঁতসেঁতে ভাব ধরে রাখার জন্য প্রতি টবের হিসেবে এই মাটিতে গড়ে তিন থেকে চার চামচ কোকোপিট মেশাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে এক মুঠো নিমখোল, এক মুঠো হাড়গুঁড়ো, হাফ চামচ সুপার ফসফেট মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নিলে একেবারে আদর্শ মাটি তৈরি হয়ে যাবে।

প্রথম টব ব্যবস্থাপনা

ছোট্ট চারার দাম নার্সারিতে স্থানবিশেষে কুড়ি থেকে তিরিশ টাকা। নার্সারি থেকে আনার পর তা দিন-দশেক বাড়িতে রেখে বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে তাকে মানিয়ে নেওয়ার সময় দিয়ে তবে টবে বসাবেন। আট ইঞ্চির টবে প্রথমে একে বসাবেন। টবের তলার ফুটোতে খোলামকুচি দিয়ে বন্ধ করে তার ওপর প্রথমে কুচো পাথরের লেয়ার বানাবেন, তার ওপর মোটা বালি দেবেন। দুটো মিলিয়ে ইঞ্চি-দুয়েকের একটা লেয়ার তৈরি করে নেবেন। এতে গাছের গোড়ায় জল জমবে না, বাড়তি জল এর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যাবে। এবার এই লেয়ারের ওপর আগের তৈরি আদর্শ মাটি দিয়ে আশিভাগ ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত করবেন। গর্তে হাফ চা-চামচ করে সাফ ফাঙ্গিসাইড ও এপসম সল্ট দিয়ে চারাটি বসিয়ে চারপাশ মাটি দিয়ে চেপে টব ভর্তি করে জল দিয়ে দেবেন। তারপর টবশুদ্ধ গাছটি পাঁচ-ছ’দিন ছায়ায় রেখে তবেই রোদে দেবেন। এই ছায়াপর্বে মাটি না-শুকোলে জল দেবেন না।        

উপযুক্ত রোদ ও খাবার

বেগুনি টগর বেশি রোদ ভালোবাসে ঠিকই, তবে কম রোদেও ফুল দিতে কার্পণ্য করে না। অর্থাৎ, আপনার ব্যালকনি বা ছাদে যদি মাত্র ঘণ্টাদুয়েক রোদ আসে, তাহলেও এই গাছ করা যাবে; আবার ছ’ঘন্টা বা সারাদিনের রোদ যদি আসে, তাতেও এই গাছ করা যাবে।

এই গাছে খুব বেশি খাবার দেবার প্রয়োজন নেই। প্রতি দশদিন অন্তর কমপক্ষে তিনদিনের পচানো সরষের খোলজল পাতলা করে দিয়ে গেলে কিংবা প্রতি পনেরো দিন অন্তর এক লিটার জলে এক চা-চামচ উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি এনপিকে গুলে দিয়ে গেলেই এই গাছ নির্দ্বিধায় ফুল দিয়ে যাবে। তবে আপনার হাতে যদি আর একটু পরিচর্যার সময় থাকে, তাহলে মাসে এক বার এই গাছে এক লিটার জলের চার ভাগের এক ভাগ জলে হাফ-গ্রাম অনুখাদ্য মিশিয়ে স্প্রে করে দেবেন, বেঁচে যাওয়া জল গোড়ায় ঢেলে দেবেন; মাসে একবার মাটিতে একমুঠো কম্পোস্ট সার দেবেন আর কুড়ি দিন অন্তর সবজির খোসা পচানো জল দেবেন আর সম্ভব হলে মাসে এক বার এক চা-চামচ এপসম সল্ট টবের মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন। তাতে এই গাছ দেখবেন ফুলের ভারে যেন একেবারে নুয়ে পড়বে।      

কাটাই-ছাঁটাই

বেগুনি টগর এমনিতে ঝাঁকড়া হয়েই বাড়ে। ফলে একে ঝাঁকড়া করার জন্য খুব একটা কাটাছাঁটার প্রয়োজন হয় না। এই গাছ যদি খুব বেঢপ আকারের হয়ে যায়, তার ডালপালার বিন্যাসে ছিরিছাঁদ যদি না-থাকে, তাহলে বছরে একবার হার্ড প্রুনিং করবেন। আর সেটা করবেন, শীতের সময়। কেননা, এই সময় গাছ কম ফুল দেয়। প্রুনিং-এর পর কাটা জায়গায় ফাঙ্গাসের আক্রমণ ঠেকাতে মনে করে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগাবেন।

তবে ছোট ছোট কাটাই-ছাঁটাই সারা বছর করতেই হবে বেশি ফুল পাওয়ার জন্য। ফোটার পর ফুলগুলো গাছে চার-পাঁচদিন থাকে, তারপর ঝরে পড়ে। ফুল ঝরার পর বৃতিতে বীজ হয়। এই বীজ হতে দেওয়ার দরকার নেই। তাতে গাছের অনেক এনার্জি ফালতু নষ্ট হয়। এই এনার্জি যাতে গাছ নতুন ফুল সৃষ্টিতে কাজে লাগাতে পারে, তার জন্য ফুল ঝরে গেলেই বৃতিটি কুচ করে কেটে দেবেন। এর ফলে আরও তাড়াতাড়ি অনেক নতুন শাখার জন্ম হবে। এক্ষেত্রে যত শাখা হবে, নতুন ফুল তত বেশি হবে।   

রোগবালাই

বেগুনি টগরের রোগবালাই সামান্যই। তবে কখনো-সখনো মিলিবাগ, সাদা মাছি ও জাবপোকা আক্রমণ করে এই গাছে। কিন্তু তার প্রকোপ সামান্যই। এক্ষেত্রে ইমিডাক্লোরোপিড গ্রুপের কীটনাশক এক লিটার জলে দুই থেকে তিন গ্রাম মিশিয়ে দু’দিন পরপর স্প্রে করলেই কেল্লাফতে।

বর্ষাকালে বা অন্য সময় টানা বৃষ্টি হলে এই গাছের শেকড়ে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হবার আশঙ্কা থাকে। তাই বর্ষাকালে প্রতি পনেরো দিন অন্তর টবের মাটিতে আধ চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড বেশ ভালো করে ছড়িয়ে দিলে এবং অন্যান্য সময় টানা বৃষ্টি হলে দু’একদিন বৃষ্টির পরই একবার ঐ একই পরিমাণ ফাঙ্গিসাইড মাটিতে ছড়িয়ে দিলেই ফাঙ্গাসের আক্রমণ ঠেকানো যাবে। 

রি-পটিং ও নতুন চারা তৈরি

একটা টবে আড়াই থেকে তিন বছর বেগুনি টগর থাকার পর তার রি-পটিং-এর প্রয়োজন হয়। গাছই এই সময় শেকড়ের জাল মাটির ওপর ফুটিয়ে তুলে বাগানিকে রিপটিং করার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই রিপটিং বছরের যে-কোন সময় করা যাবে, তবে প্রচণ্ড গ্রীষ্মে না-করলেই ভালো। রি-পটিং করার জন্য পুরনো টব থেকে মাটিশুদ্ধ গাছ বের করে চারপাশের মাটি ও শেকড় পঞ্চাশ ভাগ ছেঁটে ফেলে এক সাইজ বড় টবে যেভাবে নার্সারি থেকে আনার পর নতুন চারা বসানো হয়েছিল, সেভাবেই বসিয়ে দিতে হবে। সাতদিন ছায়ায় রেখে তারপর টবশুদ্ধ গাছ রোদে দিতে হবে।

বেগুনি টগরের চারা খুব সহজেই তৈরি করা যায়। বছরের যে-কোন সময় ডাল কেটে স্যাঁতসেঁতে দোআঁশ মাটিতে তা সাধারণভাবে বসিয়ে দিলেই হল। দিন-কুড়ির মধ্যেই এই ডাল নতুন চারায় পরিণত হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...