ব্যালকনি বা ছাদবাগানে সহজে ফোটান কসমস ফুল

শীতের অপূর্ব সুন্দর যে ফুলগুলি রয়েছে, তার মধ্যে কসমস একটু বিশেষ ধরণের ফুল। কেননা, এই ফুল প্রায় বিনা খরচে যৎসামান্য পরিচর্যায় চাষ করা যায়। এবং এভাবেই এই গাছ থেকে প্রচুর ফুলও পাওয়া যায়। এই গাছ খায় কম, ফুল দেয় বেশি। তাছাড়া বিদেশি জাতের কসমসে রঙের এত ভ্যারাইটি রয়েছে যে, তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি বাগানির দুর্বলতা তৈরি হয়। সেখান থেকেই সে প্রতি বছর শীতে প্রত্যেকের বাগানে জায়গা করে নেয়। এই গাছের পাতাও বেশ ঝুরি ঝুরি বাহারি; ফলত, পাতার বাহারে গাছও বাগানের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

কসমস মূলত দুই ধরণের হয়। দিশি ও বিদেশি। দিশি জাতের কসমস ছোট্ট ঝোপালো আকারের হয়। এই ফুলের একটাই রঙ। কমলা। এই জাতটিকে আমরা অনেক সময়ই ‘তারা গাঁদা’ বলে ডাকি। রঙের ভ্যারাইটি রয়েছে বিদেশি জাতের কসমসে। সাদা, লাল, গোলাপি, দুধে-আলতা, হলুদ, বেগুনি, মিক্সকালার ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের আবার দুটো ভাগ রয়েছে। সিঙ্গল পেটাল এবং ডাবল পেটাল।

কসমস শীতের কড়া রোদ খুব ভালোবাসে। তাই ছাদবাগানে ছ’ থেকে সাত ঘন্টা ভালো রোদ এলে, তবেই এই ফুলের চাষ করবেন। তিন-চার ঘন্টা রোদ এলেও এই গাছ হয়, কিন্তু গাছের স্বাস্থ্য ভালো হয় না, ফুলও ভালো হয় না। তাই এই ফুল চাষে কড়া রোদ খুব জরুরি একটা ফ্যাক্টর। রোদের সমস্যা থাকলে এই ফুল চাষ না-করাই ভালো।

কসমস ফুলের চারা বসানো শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে। ছোট ছোট চারা বসানো হয় এই সময়। এই ধরণের চারা বসানো চলে নভেম্বর পর্যন্ত। ডিসেম্বরের এই শেষে এসে কসমসের চারা বসাতে গেলে একটু বড় ধরণের তৈরি চারা, অর্থাৎ একটু ঝাড় হয়েছে, এমন চারা নেবেন। দেখবেন, এই চারা যেন আড়াই-তিন ইঞ্চির কালো পলিব্যাগে তৈরি থাকে, তাহলে টবে প্রতিস্থাপন করতে সুবিধে হয়। চারা নেবার সময় বেশ কয়েকটা চারা নেবেন একসঙ্গে। কারণ, দশ ইঞ্চি থেকে বারো ইঞ্চি টবে একসঙ্গে চারটে করে চারা বসালে ভালো হয়। কেননা, এই ফুলের গাছ গায়ে গা লাগিয়ে একসঙ্গে থাকতে ও বাড়তে পছন্দ করে; একা একা থাকতে ততটা পছন্দ করে না। চেষ্টা করবেন একই টবে চার রঙের চারটে ফুলের গাছ লাগাতে। তাহলে, যখন ফুল ফুটবে, তখন ডালভর্তি চার রঙের ফুলের ঝাড় মিলেমিশে বেশ সাজানো বোকের মতো দেখাবে।

কসমস দোআঁশ মাটিতে ভালো হয়। হাতের কাছে দোআঁশ মাটি থাকলে, তার সঙ্গে পঞ্চাশ পঞ্চাশ অনুপাতে ওই পুরনো মাটি ও ভার্মি কম্পোস্ট বা পুরনো গোবর সার বেশ ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেই মাটি তৈরি হয়ে যাবে। আর যদি হাতের কাছে এঁটেল মাটি থাকে, তাহলে দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, দেড় ভাগ বালি, এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা পুরনো গোবর সার ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেই মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই সময় মাটি তৈরির জন্য মাটিতে অন্য কোন সার বা খাবার মেশাবার দরকার নেই। বেশি সার দিলে এই সময় গাছ বাড়বে তরতর করে, ফুল দেবার নামও করবে না। বেশি আদরে এই গাছ বাঁদর হয়। তাই মাটি তৈরির সময় এই একবার খাবার দেওয়ার পর আর-খাবার না-দিলেও চলে। কিন্তু আপনি যদি সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে গাছের চারা বসাতেন, তাহলে গাছ ঝাঁকড়া করার জন্য মাটি একটু অন্যভাবে তৈরি করতে হত। তখন ওই আগের পদ্ধতিতে মাটি তৈরি করে তার সঙ্গে দু’চামচ সিঙ্গল সুপার ফসফেট, এক চামচ হাড় গুঁড়ো এবং দু’চামচ নিম খোল মাটিতে মিশিয়ে সেই মাটি সাতদিন রেখে দিয়ে তাতে গাছ বসাতে হত। এতে গাছ খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠত এবং ঝাঁকড়াও হত খুব তাড়াতাড়ি।

কসমস গাছ রোদ ভালোবাসলেও জল তেমন ভালোবাসে না। তাই টবের ড্রেনেজ সিস্টেম খুব ভালো রেখে টবে মাটি ভরে তাতে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড দিয়ে চারা বসিয়ে দিতে হবে। তারপর ভাসিয়ে জল দিয়ে তিনদিন গাছশুদ্ধ টবটি ছায়ায় রেখে চতুর্থ দিন থেকেই ফুলসানলাইটে দেওয়া যাবে। যে-গাছ বেশি জল ভালোবাসে না, তাদের গোড়ায় তথা শিকড়ে ছত্রাকের আক্রমণ খুব বেশি হয় এবং শিকড় পচে গাছ মারা যায়। তাই কসমস গাছে এই সমস্যা দূরে রাখতে শুরু থেকেই পনেরো দিন অন্তর এক লিটার জলে এক থেকে দু’গ্রাম ফাঙ্গিসাইড গুলে স্প্রে করতে হবে। শুরু থেকেই মাটি শুকোলে তবেই জল দেবেন, নয়তো নয়।

এই সময়ে অর্থাৎ শেষ-ডিসেম্বরে বসানো গাছে আর খাবার দেওয়ার দরকার পড়ে না পুরো সিজন জুড়ে। না-দেওয়াই ভালো। তবু যদি দিতেই হয়, তাহলে মাসে একবার দশ ইঞ্চি টবে দশ দানা ডিএপি, বারো ইঞ্চি টবে বারো দানা ডিএপি দেবেন; নয়তো আধ চা-চামচ সুপার ফসফেটের সঙ্গে এক চা-চামচ পটাশ ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দেবেন। তবে গাছে ফুল না-আসা পর্যন্ত এ-খাবার তো নয়ই, কোন খাবারই দেবেন না। বেশি খাবার পেলে এই গাছ ফুল দিতে চায় না। এই গাছ যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বসানো হত, তাহলে আগে যে খাবারের কথা বললাম, সেটা কুড়ি দিন অন্তর নিয়মিত দিতে হত অথবা পনেরো দিন অন্তর খোলপচা জল দিতে হত অথবা কুড়ি দিন অন্তর এনপিকে কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি বা উনিশঃউনিশঃউনিশ এক থেকে দেড় চা-চামচ টব প্রতি দিতে হত। এতে গাছ খুব ঝাঁকড়া হত। এই ঝাঁকড়া হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন পিঞ্চিং শুরু করতে হত। তাতে গাছে শাখার পরিমাণ আরও বাড়ত। যত শাখা বাড়ত, তত ফুলও বেশি হত। কিন্তু এই সময়ে অর্থাৎ ডিসেম্বরে তৈরি চারা বসিয়ে পিঞ্চিং করার কোন দরকার নেই। এখন ফুল দিতে দিতেই গাছ বাড়তে থাকবে, ঝাঁকড়া হতে থাকবে।

বিদেশি জাতের কসমস গাছ লম্বায় খুব বাড়ে, চার-পাঁচ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায়। তাই গাছ সোজা রাখতে টবে কঞ্চি দিয়ে খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে। গাছের গোড়ায় আগাছা হতে দেবেন না। মাঝে মাঝে মাটি খুঁচিয়ে আলগা করে দেবেন। এতে টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ভালো থাকবে, গাছের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। ফুল শুকিয়ে এলে বোঁটাশুদ্ধ কেটে ফেলে দেবেন। কসমসে এই ছাঁটাই খুব জরুরি। এতে ফুলের পরিমাণ বাড়ে, গাছ সতেজ থাকে, সহজে বুড়ো হয় না।

কসমসে রোগ-বালাই খুব একটা নেই। মাঝে মাঝে জাবের আক্রমণ হয়। আধ চা-চামচ যে-কোন কোম্পানির গুঁড়ো সাবান বা শ্যাম্পু এক লিটার জলে গুলে পর পর দু’দিন স্প্রে করে দিলেই জাব সাফ হয়ে যায়। কসমস যেহেতু শীতের ফুল। তাই গরম পড়লেই হাফ-শেডে চালান করে দিন। সেখানে কিছুদিন ফুল দেবে অল্প অল্প করে। কসমসের ফুল শুকিয়ে বীজ রাখা যায়। তা থেকে চারা তৈরি করা যায় বর্ষায়। নিজের তৈরি চারায় ফুল মন্দ ফোটে না।...   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...