শ্বেত-শুভ্রময় অপরূপ সৌন্দর্য আর অপূর্ব সুগন্ধের জন্য কামিনী ফুল আমাদের খুব পছন্দের। এই ফুল পুজোয় যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনই সাধের বাগান সাজিয়ে রাখার জন্যও এই গাছের জুড়ি নেই। কেননা, তেমন প্রুনিং ছাড়াই প্রকৃতিগতভাবে কামিনী নিজেই নিজের খুব সুন্দর ঝাঁকড়া শেপ তৈরি করতে করতে বড় হয়। এই ফুল সুগন্ধ দিয়ে সকাল ও সন্ধেতে বাগান একেবারে ভরিয়ে রাখে, মাতিয়ে রাখে।
বাংলায় এখন মূলত তিন ধরণের কামিনী দেখা যায়। এক, দিশি কামিনী। এই গাছের পাতা আকারে বড়, গাছও খুব বড় হয়। রাস্তার ধারে, অনেকের উঠোনে, বাড়ির পিছনের বাগানে মাটিতে এই কামিনী গাছ হামেশাই দেখা যায়। এই গাছে প্রচুর ফুল হয়, ফুলে দারুণ সুগন্ধ। দুই, মিনি কামিনী। এই জাতের কামিনীকে ‘ডুয়ার্ফ-ভ্যারাইটি কামিনী’, ‘চায়না কামিনী’, ‘মধু কামিনী’ প্রভৃতি নামেও ডাকা হয়। এই জাতের কামিনী খুব সুন্দরভাবে টবে করা যায়। এই জাতের পাতা দিশির তুলনায় ছোট, কিন্তু দিশির মতোই প্রচুর ফুল দেয়। তবে দিশির তুলনায় এর ফুলে সুগন্ধের তীব্রতা সামান্য কম। তিন, টেবিল কামিনী। এই জাতের কামিনীর ফুল হয় না। পাতা ক্ষুদে ক্ষুদে। এই জাতের কামিনী খুব সুন্দর বনসাই করে বাগান সাজানোর কাজে, ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
কামিনীর যে দুটো ভ্যারাইটি ফুল দেয়, তারা ফুল দেওয়া শুরু করে মে-জুন মাস থেকে। তারপর ফুল দিয়ে চলে শীতের আগে পর্যন্ত। শীতের সময়টুকু এই গাছ বিশ্রাম নেয়। তিনটি জাতের কামিনী দেখনদারিতে আলাদা হলেও তাদের চারা বসানোর নিয়ম ও পরিচর্যার ধরণ কিন্তু একই। তবে যে-দু’টি জাত থেকে ফুল পাওয়া যায়, সে-দুটি টবে রোপণ করে কীভাবে ‘বিশেষ কিছু’ পরিচর্যা করে প্রচুর ফুল আদায় করে নেওয়া যায়, কীভাব তাকে দিয়ে সাধের ছাদ বা ব্যালকনিবাগান সাজিয়ে নেওয়া যায়; আসুন সেগুলোই এবার আলোচনা করিঃ
প্রথমবার গাছ বসানোর জন্য কেমন চারা আনবেন?
কামিনী একটি শক্তপোক্ত চরিত্রের গাছ। তাই বছরের যে-কোন সময় তাকে টবে রোপণ করা যায়। তবে মে-জুন মাসে যেহেতু এই গাছ ফুল দিতে শুরু করে, সেহেতু এখন এই গাছের চারা বসানোর উপযুক্ত সময়। চারা বসানোর এক মাসের মধ্যেই আপনি ফুল আশা করতে পারবেন।
যাই হোক, বাজারের গাছওয়ালা বা নার্সারি থেকে এই গাছের চারা যখন নেবেন, তখন কমপক্ষে এক ফুট উঁচু, কমপক্ষে তিন-চারটি ডালযুক্ত, সতেজ, নীরোগ ও কীটপোকাবিহীন সুস্থ চারা ভালো করে দেখেশুনে তবেই কিনবেন। চারা বাড়িতে এনে সাতদিন রাখবেন, বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য, তারপর তার রি-পটিং করবেন।
উপযুক্ত মাটি কীভাবে তৈরি করবেন?
কামিনী হালকা মাটি পছন্দ করে। শেকড়ের কাছাকাছি মাটির হালকা ভেজা ভেজা ভাবও তার খুব পছন্দের। কিন্তু গোড়ায় জল জমা সে একদম পছন্দ করে না। গোড়ায় কিছুদিন ধরে জল জমার সমস্যা চলতে থাকলে এই গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে; এবং শেষমেশ গাছ মারা যায়। কোকোপিটযুক্ত জৈবসারসমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি তাই তার জন্য একেবারে আদর্শ। কোকোপিট মাটিতে আর্দ্রতা ধরে রাখতে যেমন সাহায্য করে, তেমনি মাটিকে আলগা রাখতেও খুব সাহায্য করে। দোআঁশ মাটি অতিরিক্ত জল বের হয়ে যেতেও সাহায্য করে।
যাই হোক, কামিনীর পছন্দের এই মাটি তৈরি করতে দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, এক ভাগ সাদা মিহি বালি, এক ভাগ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং বাকি আধ-ভাগ কোকোপিট একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নেবেন। কোকোপিট যদি হাতের কাছে পাওয়া না-যায়, তাহলে কোকোপিট ছাড়াই মাটি তৈরি করবেন। সেক্ষেত্রে দেড় ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে দেড় ভাগ সাদা বালি ও এক ভাগ আগের বলা জৈবসার মিলিয়ে মাটি তৈরি করবেন। আবার বাড়িতে পুরনো দোআঁশ মাটি থাকলে তার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বালি এবং আগের পরিমাণ জৈবসার মিশিয়ে নিলেই হবে। তারপর এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে এক চা-চামচ ফসফেট, দেড় চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড, এক চামচ নিমখোল, এক চামচ হাড়গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নিলেই কামিনীর জন্য এক্কেবারে আদর্শ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রিপটিং-এর জন্য ব্যবহার করবেন।
কেমন টবে, কীভাবে চারা বসাবেন?
কামিনী গাছ শেকড় ছড়ায় খুব দ্রুত এবং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী গাছ; তাই খুব ছোট টবে একে বসালে অল্পদিনেই শেকড় মাটির ওপরে উঠে এসে রিপটিং-এর সংকেত দেবে এবং বাড়-বৃদ্ধিও সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে দেবে। সেই জন্য প্রথমেই একে দশ থেকে বারো ইঞ্চি টবে বসাতে হবে। ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবের আশিভাগ আদর্শ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তাতে হাফ চামচ এপসম সল্ট সম্ভব হলে ছড়িয়ে দেবেন (সম্ভব না-হলে দরকার নেই), তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দেবেন।
কেমন রোদে রাখবেন? জল ও অন্যান্য খাবার কী পরিমাণ দেবেন?
রোদঃ কামিনী রোদ খুব ভালোবাসে। ডিরেক্ট সানলাইট কমপক্ষে চার ঘন্টা না-পেলে এই গাছ ফুল দেবে না। সারাদিনের রোদ পেলে এই গাছ সবচেয়ে বেশি খুশি হয় এবং প্রচুর পরিমাণে ফুল দেয়।
জলঃ টবের মাটিতে যদি কোকোপিট মেশানো থাকে, তাহলে ওপরের মাটি শুকিয়েছে দেখলে তবেই জল দেবেন; নতুবা দেওয়ার দরকার নেই। আর যদি মাটিতে কোকোপিট মেশানো না-থাকে; তাহলে টবের ওপরের মাটি খটখটে শুকিয়ে যেতে কখনোই দেবেন না। মাটি সামান্য ভেজা ভেজা আছে, এমন অবস্থাতেই জল দেবেন। প্রখর রোদে এই গাছের কোন ক্ষতি হয় না। রোদের জন্য এই গাছকে স্নান করাতে হয় না। শুধু পাতায় ধুলো বসলে মাঝে-মধ্যে এই গাছকে স্নান করিয়ে দেবেন। এই গাছ কষ্টসহিষ্ণু গাছ। টবের ড্রেনেজ ঠিক থাকলে অর্থাৎ টবের জল নীচের ফুটো বেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নেমে গেলে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতেও এই গাছের কোন ক্ষতি হয় না।
অন্যান্য খাবারঃ কামিনীর খুব বেশি খাবারের প্রয়োজন হয় না। এই গাছ খায় কম, ফুল দেয় বেশি। শুধুমাত্র জৈব খাবার দিয়েও এই গাছে প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। আবার সামান্য রাসায়নিক দিয়েও প্রচুর ফুল আদায় করে নেওয়া যায়। এরপর আপনার ইচ্ছে হলে অল্প জৈব ও অল্প রাসায়নিক দু’রকম খাবারই প্রয়োগ করে এই গাছ পালন করতে পারেন। কীভাবে সেটা করবেন, এখন সেটাই বলছিঃ
১. দশ থেকে পনেরো দিন পর পর সরষের খোল কমপক্ষে তিনদিন অথবা বাদাম খোল একদিন পচিয়ে দেবেন। একটা কাজ করবেন, হাফ লিটার জলে এক মুঠো খোল দিয়ে পচাবেন। তারপর সেই পচানো খোলজলের সঙ্গে আরও তিন লিটার জল মিশিয়ে সেই জল যতটা প্রয়োজন গাছের টবে দেবেন। এর সঙ্গে পনেরো দিন পর পর অল্টার করে আর-একটি জৈব সার দিতে পারেন। পাঁচশো গ্রামের মতো সবজি ও কলার খোসা এক লিটার জলে পনেরো দিন পচিয়ে ছাঁকনি দিয়ে তরল অংশটা ভালো করে ছেঁকে নেবেন। তারপর ঐ তরলের সঙ্গে আরও ছ’লিটার জল মিশিয়ে গাছে দেবেন। এসবের পরিবর্তে রাসায়নিক দিতে চাইলে উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি প্রভৃতি সমান রেশিওর যে-সব এনপিকে আছে, সেগুলোর যে-কোন একটা পনেরো দিন অন্তর এক চা-চামচ টবের আধভেজা মাটিতে গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দিয়ে সেই মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। অথবা পনেরো দিন অন্তর জৈব ও রাসায়নিক দুটোই অলটার করে দিতে পারেন।
২. কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন অন্তর টবের মাটিতে এক মুঠো ভার্মি কম্পোস্ট, এক চা-চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও এক চামচ মিহি হাড়গুঁড়ো ছড়িয়ে দেবেন। এতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে গাছ ফুলও দেবে বেশি।
প্রচুর ফুল পেতে অত্যন্ত আবশ্যিক পরিচর্যা কোনটি?
নিয়মিত যে খাবারগুলো দেওয়ার কথা বলেছি, সেগুলো দেওয়ার পরও যদি দেখেন যে, গাছ পর্যাপ্ত ফুল দিচ্ছে না; তাহলে যা যা করতে হবে সেগুলো এবার বলছিঃ
১. কামিনী ফসফরাস খুব ভালোবাসে। এক চা-চামচ গুঁড়ো ফসফেট এবং আধ চা-চামচ লাল পটাশ একসঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণটি কুড়ি দিন অন্তর গাছের গোড়া থেকে দূরে টবের আধভেজা মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন। তারপর আধঘন্টা পর টবের মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। এটা নিয়ম করে চলতে থাকবে যতক্ষণ না-পর্যাপ্ত ফুল আসছে। এবং পর্যাপ্ত ফুল পাওয়ার পরও এই বিশেষ খাবার মাসে একবার চালিয়ে যেতে হবে।
২. মাসে একবার দুই থেকে তিন গ্রাম অণুখাদ্য এক লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করে দেবেন।
৩. পর্যাপ্ত খাবার দেওয়ার পাশাপাশি মাসে একবার মিরাকুলান স্প্রে করবেন। খাবার দেওয়ার তিনদিন পর এক লিটার জলে পঁচিশ ফোঁটা মিরাকুলান মিশিয়ে ভালো করে গাছে স্প্রে করে দেবেন। এতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, গাছ সতেজ-সবুজ থাকবে, কুঁড়ির সংখ্যাও বাড়বে।
গাছে পর্যাপ্ত ফুল পেতে নিয়মিত খাবার দেওয়ার পাশাপাশি এই বিশেষ পরিচর্যাগুলো চালিয়ে গেলে, এটা নিশ্চিত যে, কামিনী আপনাকে নিরাশ হওয়ার সুযোগ দেবে না।
গাছকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর উপায় কী?
কামিনীর তেমন কোন রোগবালাই নেই। পোকামাকড়ের সমস্যাও তেমন নেই। এদিক থেকে এই গাছ এক্কেবারে লক্ষ্মীগাছ।
কাটাই-ছাঁটাই ও রি-পটিং কোন সময় করবেন?
কামিনীর শেকড় খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তবে শেকড়ের তুলনায় গাছ একটু ধীরে বাড়ে। তবু তার উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা পছন্দমতো শেপ দিতে বছরে একবার হালকা প্রুনিং করবেন। আর বছরে একবার অবশ্যই রি-পটিং করবেন। এটা করবেন শীতের ঠিক আগে। এক্ষেত্রে গাছের শেপ ঠিক রেখে আলতো ছেঁটে কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। তারপর পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর শতাংশ শেকড় ছেঁটে আগে দশ ইঞ্চিতে থাকলে বারো ইঞ্চিতে আর বারো ইঞ্চিতে থাকলে বারো ইঞ্চি টবেই রি-পটিং করবেন। আদর্শ মাটি তৈরি করে, টবের ড্রেনেজ ঠিক রেখে সেই মাটি কিছুটা দিয়ে তার ওপর এক চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর ছাঁটাই করা গাছটা বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর টবে কানাভর্তি জল দিয়ে এবং তিন-চারদিন ছায়ায় রেখে তবে টবশুদ্ধ গাছ রোদে রাখবেন।
নতুন চারা তৈরি করবেন কীভাবে?
বছরের যে-কোন সময় রুট-হরমোন দিয়ে কামিনীর আঙুল-মোটা ডাল থেকে চারা তৈরি করে নেওয়া যায়। রুট-হরমোন লাগিয়ে কাটা ডাল দোআঁশ বা বেলে মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাটি সবসময় হালকা ভেজা ভেজা রাখবেন। তাতেই পঁচিশ থেকে তিরিশ দিনের মধ্যে আপনি কামিনীর নতুন চারা পেয়ে যাবেন। এছাড়া কামিনীর ফুল থেকে বীজ হয়। এই বীজ থেকেও আপনি চারা তৈরি করে নিতে পারবেন।