ব্যালকনি-ছাদে প্রচুর পরিমাণে ফোটান ক্যালেন্ডুলা ফুল

শীতের যে-সব বিদেশি ফুল বাঙালির বাগানে শোভা পায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম বোধহয়, ‘ক্যালেন্ডুলা’। বিদেশি পুষ্পপ্রিয় মানুষ ও বাগানি ছাড়া আপামর সাধারণের কাছে তার পরিচিতি অন্য এক আবেগের সূত্র ধরে, সেই আবেগের সঙ্গে অন্যান্য ঋতুর সঙ্গে শীতকালও বিশেষভাবে জড়িত। সেই যে দূরদর্শনের যুগে, ‘বোরো...ক্যালেন্ডুলা, লা লা লা’ জিঙ্গল, যা আমাদের ঠোঁটে অনায়াসেই স্থান করে নিয়েছিল। তার আগেই অবশ্য বোরোলীনের সঙ্গে বোরোক্যালেন্ডুলা ক্রিমও আমাদের মধ্যবিত্তজীবনের ওঠাপড়ার সঙ্গে সহজেই জড়িয়ে পড়েছিল। সেই সঙ্গে তার টিউব ও প্যাকেটের গায়ে আঁকা জোড়া হলুদ ক্যালেন্ডুলা ফুলও আমাদের নান্দনিক রুচির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। শীতে এখন তো শখের বাগানিদের সকলের বাগানেই এ ফুল শোভা পায়। ছোট ছোট গাছে উজ্জ্বল পাঁপড়ির আলোয় এই ফুল সমস্ত বাগান যেন অকাল দীপাবলির মতো সাজিয়ে রাখে।

ক্যালেন্ডুলার অনেক রকমের ভ্যারাইটি আছে। কয়েক রকমের রঙ আছে। তবে তার মধ্যে হলুদ ও কমলা রঙের কালেন্ডুলাই আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। লালচে ক্যালেন্ডুলাও আছে, তবে খুব কম বাগানির কাছেই আছে। যাই হোক, পাঁপড়ির বিন্যাসের দিক থেকে এই ফুল আবার দু’রকমের হয়। সিঙ্গল পেটাল ও ডবল পেটাল বা থোকা। সিঙ্গল পেটাল ফুল দেখতে তো অসাধারণ বটেই; কিন্তু ডবল পেটালের সৌন্দর্যই আলাদা, অপূর্ব...অপূর্ব...

অনেকের ধারণা যে, শীতের ফুল মানেই, শীতের আগে চারা বসিয়ে ফেলতে হয়; পরে বসিয়ে লাভ নেই। এমন ধারণার তেমন কোন মানে নেই। শীতের ফুলের চারা ফুল-বিশেষে ও স্থান-বিশেষে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্তও বসানো যায়। অনেকে বসিয়েও থাকেন। ক্যালেন্ডুলা সেই লেটে করার জন্য উপযুক্ত ফুল। আসলে, শীতের ঠিক আগে চারা বসালে তাকে লালনপালন করে ফুল পাওয়ার অন্য এক আনন্দ পান বাগানি; আবার দেরিতে বসালে লালনপালন বাদে সটান ফুল পাওয়ার আনন্দ পান—আগে-পরে চারা বসানোর এটুকই জাস্ট ফারাক আর কী। কাজেই, যার যে আনন্দে তৃপ্তি, তিনি সেভাবেই চাষ করেন।

মোট কথা, আপনার ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে যদি পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা রোদ আসে তাহলে এখনই এবার আপনি নির্দ্বিধায় ক্যালেন্ডুলা ফুলের চারা কিনে আনার কথা ভাবতে পারেন। অবশ্য এর চেয়ে কম, মানে তিন থেকে চার ঘন্টার কড়া রোদেও আপনি গাছ করতে পারবেন। কিন্তু তার চেয়ে কম সময়ের জন্য রোদ এলে ভালো ফুল পাবেন না। কেননা, এই গাছ শীতের ভরপুর রোদ খুব ভালোবাসে।

যাই হোক, এই সময় আপনি যখন ক্যালেন্ডুলার চারা বাজার থেকে আনবেন, প্রায় এক মাস বয়সের চারা কিনে আনবেন। মানে, সামান্য ঝাড়ওয়ালা তিন ইঞ্চির পলিব্যাগে তৈরি চারা কিনে আনবেন। এই চারা বাড়িতে এনে দিনচারেক রেখে গাছকে বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার মিনিমাম সময়টুকু দিয়ে টবে বসাবেন। পলিব্যাগের তৈরি চারা টবে বসালে গাছের খুব একটা শক হয় না। তার জন্য অবশ্য খুব সাবধানে মাটিশুদ্ধু চারা পলিব্যাগ থেকে মুক্ত করে টবে বসাবেন, চারপাশে মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর জল দিয়ে তিনদিন শেডে রেখে চতুর্থ দিন ফুল সানলাইটে দেবেন। গাছ হয়তো ফুল সানলাইটে দিলে ক’দিন একটু ঢলে ঢলে যাবে, আবার বিকেল ও রাত্রে সতেজ হয়ে উঠবে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ক’দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

যদি আপনার কাছাকাছি গাছবিক্রেতার কাছ থেকে এক মাস বয়সের পলিব্যাগে তৈরি চারা না-পান; তাহলে বাধ্য হয়েই লুজ উপড়ে আনা চারা একটু বড় সাইজের দেখে নেবেন বা ছোট থাম্বপটের ছোট চারা পেলে সেটাও নেবেন। এই সব চারা থেকে গাছ তৈরি করে জানুয়ারির শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আপনি অবশ্যই ফুল পাবেন, কোন চিন্তা নেই। উপড়ে আনা চারা যদি আনতেই হয়, তাহলে মাটি তৈরি করে রাখবেন; যাতে চারা এনেই টবে বসিয়ে দেওয়া যায়। গাছ এনে নেতিয়ে পড়ার সময় দেওয়া চলবে না।

ক্যালেন্ডুলা বেলে-দোআঁশ মাটি খুব ভালোবাসে। তাই এঁটেল মাটি, মোটা বালি এবং ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার সমান পরিমাণে নিয়ে একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নিলেই ক্যালেন্ডুলার মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এছাড়া আপনার কাছে ব্যবহৃত পুরনো টবের মাটি থাকলে মাটিটা দু’দিন ধরে রোদে শুকিয়ে নিয়ে ঝুরঝুরে করে নিন আগে। তারপর তাতে দশভাগ বালি ও তিরিশভাগ ভার্মি বা গোবর মিশিয়ে নিন মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এবার এই মাটি ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে আট বা দশ ইঞ্চির টবের (এর চেয়ে বেশি বড় টব ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই) আশিভাগ ভরে নেবেন। তারপর মধ্যিখানে গর্ত করে চা-চামচের চারভাগের একভাগ এপসম সল্ট (এপসম সল্ট গাছকে সতেজ রাখে, সব রকমের আঘাত বা শক ভুলে বেঁচে থাকতে খুবই সাহায্য করে) সেই গর্তে দিয়ে তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে তা ভালো করে চেপে দেবেন। এবার টব ভাসিয়ে জল দিয়ে ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে দিন চার-পাঁচদিন। এই পর্ব পেরোবার পর গাছ টান টান সতেজ রয়েছে দেখে তবেই টবশুদ্ধ গাছ ফুলসানলাইটে দেবেন।

ক্যালেন্ডুলা রোদ ভালোবাসে, জল তেমন ভালোবাসে না। শুধু তেষ্টার প্রয়োজন মিটলেই সে খুশি। তাই ক্যালেন্ডুলার টবে প্রথম থেকে অর্থাৎ চারা আনা বা বসানোর সময় থেকেই বুঝে বুঝে জল দিতে হবে। ওপরের মাটি শুকিয়ে গেলে তবেই জল দেবেন, নয়তো নয়। খেয়াল রাখতে হবে, গাছের গোড়ায় জল যাতে একদম না-জমে। এবং আগাছা হলেই তুলে ফেলতে হবে।

ক্যালেন্ডুলার খুব বেশি খাবারের চাহিদা নেই। চারা বসানোর পর নতুন দুটো পাতা গজানোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তারপরই শুরু করতে হবে খাবার দেওয়া। তাতে সপ্তাহে একদিন করে তিনদিনের খোলপচা জল পাতলা করে দিলেই সে খুশিতে ডগমগ করতে করতে ফুল দেবে। ক্যালেন্ডুলা ভালো শীত পড়লে এবং এক মাসের বেশি বয়স হলে এমনিতেই ফুল দেয়। ফুল দেওয়াতে এর তেমন বায়নাক্কা একেবারেই নেই। তবে একটু বেশি ফুল দিতে, ভালো ঝাড় কাটতে একস্ট্রা কেয়ার কে না চায়! তাই সামান্য বাড়তি যত্ন নিতে হবে।

ক্যালেন্ডুলা গাছ ফসফেট সার খুব ভালোবাসে। প্রতি পনেরো দিন অন্তর সামান্য পটাশের সঙ্গে মিশিয়ে এক চা-চামচ গুঁড়ো সিঙ্গল সুপার ফসফেট টব প্রতি দিয়ে যেতে হবে। গাছের গোড়া থেকে দূরে আধভেজা মাটিতে এই সার চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। দশদিন অন্তর এক লিটার জলে এক চা-চামচ এপসম সল্ট বেশ করে গুলে গাছের পাতায় স্প্রে করবেন। এতে গাছ সতেজ, সবুজ থাকবে, পাতা চকচক করবে। গাছে ফুলও বেশি আসবে। আর দশ-বারোদিন অন্তর অন্তর টব প্রতি সাত-আট দানা করে ডিএপি ও উনিশঃউনিশঃউনিশ এনপিকে সার অলটার করে পারলে দেবেন। নইলে, শুধু ডিএপিই দেবেন। ব্যস, খানাপিনার ব্যবস্থাপনায় এর বেশি কিছুই আর করার নেই। এতেই প্রচুর ফুল ফুটবে আপনার ক্যালেন্ডুলায়।

মাস পেরোলেই গাছে ফুল আসবে। বাগানে শোভা বাড়বে। এই সময় খেয়াল করে ফুল শুকিয়ে এলেই তা অমনি কেটে ফেলবেন। তাতে দেখবেন, ফুলের পরিমাণ বাড়বে। শীত শেষ হয়ে এলে গরম পড়তে শুরু করলে গাছ সটান শেডে চালান করে দেবেন। তাতে এপ্রিল পর্যন্ত কমবেশি ফুল পাবেন। গাছ বুড়িয়ে এলে ফুল রেখে গাছেই শুকিয়ে বীজ রাখতে পারেন। গাঁদার মতো ক্যালেন্ডুলাতেও ওই এক পদ্ধতিতে পরের বছরের জন্য বীজ রাখা যায়। কিন্তু তেমন লাভ হয় না। অনেকের চারাই হয় না, যাদের হয়, ফুলের কোয়ালিটি ভালো হয় না। তার চেয়ে ওসব ঝক্কির মধ্যে না-গিয়ে বছর বছর ক্যালেন্ডুলার চারা কিনে লাগানোই ভালো; তাতে আর যাই হোক, কোয়ালিটিতে কম্প্রোমাইজ হয় না।।...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...