কেউ বলেন ‘বেলফুল’, কেউ বলেন ‘বেলি’। তবে নাম যা-ই হোক না কেন, স্নিগ্ধ-সুগন্ধ ও অপরূপ শুভ্রতা দিয়ে এই ফুল আমাদের একেবারে আমোদিত করে রাখে; ভরিয়ে রাখে, সাজিয়ে রাখে আমাদের সাধের বাগান, পুজোর ডালি। মাটিতে এই গাছ রোপণ করলে তেমন কোনও পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না, অল্পেতেই অকৃপণভাবে সে গরমের সূচনা থেকে শীতের সূচনা অব্দি দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর ফুল দেয়। আমরা যেহেতু ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে টবে এই ফুলের চাষ করি বা করবো; তাই এর সামান্য পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। আর পরিচর্যা শুরুর জন্য এই ফেব্রুয়ারি মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় আপনি কীভাবে এই গাছের পরিচর্যা করবেন, সেগুলো সূত্রাকারে সাজিয়ে দিচ্ছিঃ
বেলফুল গাছের প্রুনিং
প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট সময়ে গাছের ডাল ও শেকড়ের কাঁটাই-ছাঁটাই করাই হল ‘প্রুনিং’। বেলফুল গাছ বছরের পাঁচটি ঋতুতে কয়েক দফায় ফুল দেয়, কেবলমাত্র শীতকালে সে ফুল দেয় না। কিছু কিছু গাছে অবশ্য হালকা শীতেও ফুল দেখা যায়। তবে জাঁকিয়ে শীত পড়লে তারাও ফুল দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মোট কথা, শীত হচ্ছে বেলফুল গাছের বিশ্রামের সময়।
আমরা জানি যে, প্রুনিং হল দু’রকমের, হার্ড প্রুনিং এবং হালকা প্রুনিং। বেলফুল গাছের হার্ড প্রুনিং বা সপাট-ছাঁটাই বছরে দু’বার করা যায়, শীতের ঠিক আগে এবং শীতের ঠিক পরে। শীতের আগে যদি না-করে থাকেন, তাহলে গাছের গ্রোথ ঠিক করতে এবং বেশি বেশি ফুল পেতে ফেব্রুয়ারিতে আপনাকে হার্ড প্রুনিং করতেই হবে। হার্ড প্রুনিং-এ যে-সব গাছের বয়স দু’বছরের কম, তাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ডাল ছাঁটাই করলেই হবে, শেকড় ছাঁটাই করার দরকার নেই। কিন্তু গাছের বয়স দু’বছর হয়ে গেলেই আপনি দেখবেন যে গাছের শেকড় টবের মাটির ওপরে উঠে এসেছে, গোড়ার অংশে ঠেসমূলের মতো শেকড়ের বিন্যাস দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ডাল ছাঁটাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে শেকড় ছাঁটাই করে মাটি চেঞ্জ করে টব চেঞ্জ করে রিপটিং করতে হবে।
এই সময় হার্ড প্রুনিং-এর ক্ষেত্রে টবের মাটির ওপরে দশ ইঞ্চি মতো গাছ রেখে তার ওপরের অংশটা বিলকুল কেটে ফেলুন। কাটা জায়গায় ফাঙ্গিসাইড পেস্ট করে লাগিয়ে দিন। গাছের গোড়ার চারপাশের মাটি অর্থাৎ টবের ওপরের মাটি দু’ইঞ্চি মতো সমানভাবে চেঁছে তুলে ফেলে দিন। এবার ঐ জায়গায় নতুন ‘তৈরি করা মাটি’ (এই মাটি তৈরির পদ্ধতি পরে বলছি) দিয়ে ভরাট করে বেশ ভালো করে জল দিয়ে টবশুদ্ধ সেমিশেডে রেখে দিন। দু’বছরের কম বয়সী গাছের ক্ষেত্রে এটুকু করলেই যথেষ্ট।
এবার দু’বছরের বেশি বয়সের গাছের ক্ষেত্রেও আগের পরিমাপ মতো ডালপালা ছাঁটাই করে ফেলুন। তারপর গাছের গোড়ায় হাত রেখে টবটা উপুড় করে টোকা দিলেই মাটিশুদ্ধ গাছটা সুন্দরভাবে টব থেকে বেরিয়ে আসবে। এবার দেখুন এই বেরিয়ে আসা মাটিটা আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে শেকড়ে শেকড়ে ছয়লাপ করে দিয়েছে গাছ, এই শেকড়গুলো কাটতে হবে। ধারালো ছুরি দিয়ে পঞ্চাশভাগ মাটি ও শেকড় সুন্দরভাবে কেটে ফেলে দিতে হবে। টব থেকে মাটিশুদ্ধ গাছ অনায়াসে বের করার জন্য আগের দিন টবে কিন্তু জল দেওয়া চলবে না, তাহলেই হবে। যাই হোক, এভাবে কাঁটাই-ছাঁটাই হয়ে গেলে ডাল এবং মোটা মোটা শেকড়ের কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। তারপর নতুন ‘তৈরি করা মাটি’ (এই মাটি তৈরির পদ্ধতি পরে বলছি) আগের টবের থেকে এক সাইজ বড় একটি টব নিয়ে তাতে ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে অর্ধেকটা চেপে চেপে ভরে ফেলুন। এবার তার ওপরে এক চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেশিয়াম সালফেট (এটা শেকড় ও ডাল ছাঁটাইয়ের ফলে গাছের যে ধকল হয়েছে, সেটা খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠে গাছকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে খুব সাহায্য করে) ছড়িয়ে তার ওপর সুন্দর ছাঁটাই করা মাটিশুদ্ধ বেলিগাছটা বসিয়ে চারপাশে চেপে চেপে মাটি দিয়ে টবের আশিভাগ ভর্তি করে ফেলুন। তারপর বেশ ভালো করে জল দিয়ে টবশুদ্ধ গাছটি সাতদিনের জন্য ছায়ায় রেখে আটদিনের দিন রোদে দিন।
এবার বলি হালকা প্রুনিং বা ছাঁটাই-এর কথা। এটা আপনাকে সারা বছরই করতে হবে। এই ফুলের গাছে যত নতুন শাখা হবে, তত বেশি ফুল ফুটবে। তাই একবার ফুল হয়ে গেলে সেই শাখার আগা ছেঁটে ফেলতে হবে। এভাবে ছেঁটে ফেললেই দেখবেন পাতার ভাঁজ থেকে নতুন নতুন অনেক শাখার জন্ম হচ্ছে এবং অনেক বেশি বেশি ফুল হচ্ছে।
আর একটা কথা, সারা বছরই মাঝে মাঝে দেখবেন গাছের গোড়া থেকে এক বা একাধিক লতানো শাখার জন্ম হচ্ছে। এমন শাখা বেঢপ লতার মতো তরতরিয়ে বেড়েই চলে, সহজে ফুল হয় না। এদের তাই বাড়তে না-দিয়ে টুক করে কেটে ফেলবেন। এতে গাছের শেপ ভালো থাকবে, খাবারের অপচয়ও হবে না।
মাটি তৈরি ও জল ব্যবস্থাপনা
বেলফুল গাছ গোড়ায় জমা জল একদম পছন্দ করে না। তাই এর জন্য মাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে জল একদমই না-জমে। এক্ষেত্রে এঁটেল মাটি দেড় ভাগ নিয়ে তার সঙ্গে দেড় ভাগ বালি ও এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর অথবা পাতাপচা সার ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেই হবে। এই মাটির স্বাস্থ্য আরও ভালো করতে আপনি এর সঙ্গে মেশাতে পারেন প্রতি টবের হিসেবে এক চামচ নিমখোল, এক চামচ হাড়গুঁড়ো, এক চামচ শিং-কুচি, এক চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড, এক চা-চামচ ফসফেট ও এক চা-চামচ পটাশ। এভাবে মাটি তৈরি করে আপনি যেমন নতুন চারাগাছ বসাতে পারবেন, তেমনি হার্ড প্রুনিং করার পর এই মাটি গাছের গোড়ায় দিয়ে টব ভরাট করতে পারবেন, আবার রিপটিংও করতে পারবেন।
বেলফুল গাছ গোড়ায় জমা জল পছন্দ না-করলেও মাটিতে একটা স্যাঁতসেঁতেভাব পছন্দ করে। তাই জল দেবার সময় খেয়াল রাখবেন, এই গাছের মাটি কখনোই যেন খটখটে হয়ে শুকিয়ে না-যায়। প্রয়োজনে প্রচণ্ড গরমের সময় দিনে দু’বার জল দেবেন। যে-কোন একটা সময় গাছকে স্নান করিয়ে জল দেবেন। এই গাছ যেহেতু ভেজা ভেজা মাটি পছন্দ করে, তাই অনেকেই মাটি তৈরির সময় মাটিতে কিছুটা কোকোপিট মিশিয়ে থাকেন। কেননা, এটা মাটিতে ভেজা-ভেজা-ভাব বজায় রাখতে খুব সাহায্য করে।
টবের মাটিতে আগাছা হতে কখনই দেবেন না। সপ্তাহে একবার স্টিলের কাঁটাচামচ দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে আলগা করে দেবেন।
খাবার দেওয়ার পদ্ধতি
হার্ড প্রুনিং-করার পর গাছের নতুন পাতা না-বেরনো অব্দি কোন খাবার দিতে হবে না। নতুন শাখা দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি সাইজের হলে শুরু করতে হবে খাবার দেওয়া। এই সময় থেকে প্রতি দশদিন অন্তর সরষের খোল কমপক্ষে তিনদিন ভিজিয়ে পাতলা করে অর্থাৎ এক মগের সঙ্গে ছ’মগ সাধারণ জল মিশিয়ে দিতে থাকুন। এর পরিবর্তে এভাবেই বাদামের খোল ভেজানো জল দিতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে খোল আধ-দিন বা একদিন ভিজিয়ে দিলেই হবে।
ফসফরাস ও পটাশ প্রচুর ফুল ফোটাতে সাহায্য করে। তাই কুড়ি দিন পর পর টব প্রতি এক চা-চামচ করে ফসফেট ও পটাশ গাছের গোড়া থেকে দূরে টবের ধার ঘেঁষে দেবেন। এর পরিবর্তে দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ যত ইঞ্চির টব ততগুলো দানা গুণে গুণে টবের ধার ঘেঁষে দেবেন। এর পরিবর্তে শুধুমাত্র জৈব পদ্ধতিতে এই গাছে বেশি ফুল পেতে হলে দশদিন অন্তর কলার খোসা ভেজানো জল পাতলা করে দিতে হবে। এই গাছ অম্লযুক্ত মাটি পছন্দ করে, তাই এর সঙ্গে পনেরো দিন অন্তর কফিগোলা জল দিলেও বেশি ফুল পাওয়া যায়। জৈব পদ্ধতির চাষে মাসে একবার এক চামচ করে হাড়গুঁড়ো, শিং-কুচি ও রক্তসার নিয়মিত দিলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ফুলও বেশি পাওয়া যায়। রাসায়নিকের সঙ্গেও প্রতি মাসে এগুলো ইচ্ছে করলে আপনি দিতে পারেন।
বেলফুল গাছের পাতা মাঝে মাঝে কুঁকড়ে যায়, ফেটে যায়। এটা হয় নানান অনুখাদ্যের অভাবে। পঁচিশ দিন অন্তর গুঁড়ো অনুখাদ্য দু’গ্রাম এক লিটার জলে এবং তরল অনুখাদ্য পঁচিশ থেকে তিরিশ ফোঁটা এক লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করলেই হবে। এতে গাছ যেমন সুস্থ থাকবে, তেমনি বেশি বেশি ফুলও দেবে।
নতুন গাছের ক্ষেত্রে চারা বসানোর দিন-কুড়ি পর থেকে রুটিন-মাফিক যে খাবার, সেগুলো দেওয়া শুরু করবেন।
রোদের চাহিদা
বেলফুল গরমের ফুল হলেও ডিরেক্ট সানলাইট এর খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। পছন্দও করে না। দিনে ঘন্টা দুয়েক ডিরেক্ট সানলাইট পেলেই সে খুশি। বাকিটা সময় আলোছায়ায় থাকতেই সে বেশি পছন্দ করে। দুপুরের প্রখর রোদ এই গাছের পাতা বিবর্ণ করে দেয়, ফুল পুড়িয়ে দেয়, গাছের বৃদ্ধিকেও ব্যাহত করে। ফলত, এই গাছ ব্যালকনি বাগানের জন্য একেবারে আদর্শ, শেডযুক্ত ছাদবাগানের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত।
রোগবালাই
বেলফুল গাছের রোগবালাই তেমন নেই। শুধু মাঝে মাঝে ল্যাদা পোকা পাতা খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। তার জন্য নিয়মিত ওষুধ দেবার দরকার নেই। একদিনেই এই পোকা সব পাতা খেয়ে দেয় না। তাই পোকায় খাওয়া পাতা চোখে পড়লেই অনুমোদিত কীটনাশক এনে স্প্রে করে দেবেন।
নতুন চারা তৈরি
নতুন চারা তৈরি বেলফুলের ক্ষেত্রে খুব সহজ। প্রুনিং-এর সময় ডাল ছাঁটলে, তা যে কোন মাসেই হোক না-কেন, ছায়াযুক্ত স্থানের যে-কোন ধরণের ভেজামাটিতে ডাল পুঁতে দিলেই অল্পদিনে প্রতিটি কাটা ডাল থেকে এক-একটি নতুন চারা পাওয়া যায়। ফলত, একটি গাছ থেকে এইভাবে খুব সহজেই যতগুলো ইচ্ছে বেলফুল গাছ নিজে নিজেই তৈরি করে নেওয়া যায়।