এলামণ্ডাকে বাংলায় ‘অলকানন্দা’ বলা হয়। এই ফুলের গাছ অল্প পরিচর্যাতেই অনেক ফুল দেয়। খুব সহজেই টবে একে চাষ করা যায়। এর দুটো ভ্যারাইটি। একটা ভ্যারাইটির সরু-লম্বাটে পাতা দেখা যায়। ফুলের একটাই রঙ, হলুদ। এই ধরণের গাছ কাঁটাই-ছাঁটাই করে ঝোপালো করা যায়, সুন্দর একটা শেপ দেওয়া যায় সহজেই। অন্য ভ্যারাইটিটার পাতা কিছুটা বড়। সেটা লতানে ধরণের গাছ। তার নানান গাছে হলুদ ছাড়াও গোলাপি, লাল, ফিকে লাল, বেগুনি, ফ্যাকাসে সাদা প্রভৃতি হরেক রঙের ফুল পাওয়া যায়। আগের ভ্যারাইটির তুলনায় এই জাতের ফুলের সাইজ কিন্তু বড় হয়। তবে দুটো ভ্যারাইটির গাছেই এপ্রিল থেকে অক্টোবর অব্দি খুব ভালো পরিমাণে ফুল পাওয়া যায়।
কিন্তু, এই ফুলের গাছ নভেম্বরের শুরু থেকে ফুলের পরিমাণ কমতে কমতে মাসের শেষদিকে শীত বাড়তে আরম্ভ করলেই ফুল দেওয়া বন্ধ করে দেয়। শীতকাল এই গাছের ঘুমের সময়, তাই এই সময় সে ফুল দেয় না। ঘুম থেকে সে ওঠে অল্প গরম পড়তে শুরু করলেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে। ফলে, আপনার বাগানে পুরনো গাছ থাকলে মার্চের প্রথম থেকেই এর বিশেষ পরিচর্যা শুরু করে দিতে হয় সামনের এপ্রিলে অনেক ফুল পাওয়ার জন্য। আর যদি আপনার বাগানে এই গাছ না-থাকে, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যে অবশ্যই পছন্দের রঙের পছন্দের ভ্যারাইটির একটি সতেজ চারা এনে আপনার বাগানের টবে বসিয়ে দিন। কেননা, এই গাছের ফুল অপূর্ব সতেজ-সৌন্দর্যে বাগান একেবারে আলো করে রাখে। এই গাছ কীভাবে বসাবেন, সে-কথা এখন বলবো তারপরেই বলছি বিশেষ-নির্বিশেষ সমস্ত পরিচর্যার কথাঃ
উপযুক্ত মাটি কীভাবে তৈরি করবেন?
এলামণ্ডা ভেজা ও হালকা মাটি পছন্দ করে, কিন্তু গোড়ায় জল জমা একদম পছন্দ করে না। সুতরাং তার জন্য জৈবসারসমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি তৈরি করতে হবে। জৈবসার শেকড়-সংলগ্ন মাটিতে ভেজা ভেজা ভাব বজায় রাখতে খুব সাহায্য করে। তাই উপযুক্ত দোআঁশ মাটি তৈরি করতে সমান পরিমাণে এঁটেল মাটি, সাদা মিহি বালি, এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নেবেন (পুরনো দোআঁশ মাটি থাকলে তার সঙ্গে সমান পরিমাণে আগের বলা জৈবসার মিশিয়ে নিলেই হবে)। তারপর এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে এক মুঠো সরষের খোল গুঁড়ো, দেড় চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড, হাফ চামচ দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ ভালো করে মিশিয়ে নেবেন, তাহলেই এলামণ্ডার জন্য আদর্শ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রিপটিং-এর জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
কেমন টবে, কীভাবে চারা বসাবেন?
প্রথম বার এই গাছ করতে আট থেকে দশ ইঞ্চির টব ব্যবহার করবেন। এর চেয়ে বড় টবের এই মুহূর্তে দরকার নেই। ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবের আশিভাগ আদর্শ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তাতে হাফ চামচ এপসম সল্ট সম্ভব হলে ছড়িয়ে দিন (সম্ভব না-হলে দরকার নেই), তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দিন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে দিন। চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দিন।
কেমন রোদে রাখবেন? জল ও অন্যান্য খাবার কী পরিমাণ দেবেন?
রোদঃ এলামণ্ডা রোদ খুব ভালোবাসে। কমপক্ষে পাঁচ ঘন্টা রোদ তার চাই-ই চাই ভালো ফুল দেওয়ার জন্য। সারাদিন রোদ পেলে আরও ভালো, তখন যেন তার আনন্দের সীমা থাকে না। হেসেখেলে প্রচুর ফুল দেয়।
জলঃ ওপরের মাটি যখন দেখবেন শুকিয়ে গেছে দেখলেই টবে জল দেবেন। নতুবা দরকার নেই। বেশি জল দেওয়া হয়ে গেলে ভয় নেই, গোড়ায় না-জমে থাকলেই হল। মনে রাখবেন, নিয়মিত গোড়ায় জল জমলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে যায়, পরবর্তীতে গাছ মারা যায়। তবে টবের ড্রেনেজ ঠিক থাকলে টানা বর্ষাতেও এ-গাছের কোন ক্ষতি হয় না।
অন্যান্য খাবারঃ দশদিন অন্তর খাবার হিসেবে এই গাছকে সরষের খোলপচা জল পাতলা করে দিয়ে যাবেন। কুড়ি দিন অন্তর টবের ধার ঘেঁষে গোড়া থেকে দূরে এক চা-চামচ দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ ছড়িয়ে দেবেন। মাসে একবার এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সম্ভব হলে এক চা-চামচ মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন। এতে ম্যাগনেসিয়ামের অভাবজনিত কারণে গাছের পাতা কখনই হলুদ হবে না। তাছাড়া গাছে ফুলের পরিমাণ বাড়াতে এবং সব রকমের ট্রেস কাটাতে এটি খুবই উপকারী। মাসে একবার এক মুঠো ভার্মি কম্পোস্ট টবে ছড়িয়ে দেবেন। এ-টুকু খাবারের ব্যবস্থা নিয়মিত করে গেলেই প্রচুর ফুল পাবেন পুরো সিজন জুড়ে।
তবে সময় হলেও গাছে যদি ফুল না-আসার সমস্যা দেখা যায়, তাহলে পনেরো দিন অন্তর এক চা-চামচ লাল পটাশ মাটিতে প্রয়োগ করবেন। খাবার দেবার দিন-তিনেক পর মিরাকুলান পঁচিশ ফোঁটা এক লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করবেন, অবশ্যই ফুল আসবে এক মাসের মধ্যে।
গাছকে রোগবালাই ও পোকামাকড় থেকে বাঁচানোর উপায় কী?
রোগবালাই এ-গাছের তেমন নেই। পোকামাকড়ের উপদ্রবও বিশেষ নেই। তবে কখনও কখনও সাদা মাকড়ের উপদ্রব দেখা যায়। সেগুলো গাছের ক্ষতি করছে দেখলে থাইমেথোক্সাম-জাতীয় কীটনাশক তিন গ্রাম এক লিটার জলে গুলে স্প্রে করে দেবেন, তাতেই উপকার পাবেন।
কাটাই-ছাঁটাই ও রি-পটিং কোন সময় করবেন?
এপ্রিল থেকে অক্টোবর যেহেতু এই গাছের ফুল দেওয়ার সময়, তাই এ-সময় একে ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। হার্ড প্রুনিং শীত শুরু বা শেষ হওয়ার ঠিক আগে করবেন এবং রি-পটিংও এই সময়ই করার চেষ্টা করবেন। তবে প্রয়োজনে গ্রীষ্ম ছাড়া যে-কোন সময়ই এই গাছের হার্ড প্রুনিং ও রি-পটিং করা যাবে; ফুল-ফোটায় সাময়িক বিঘ্ন হওয়া ছাড়া, দ্বিতীয় কোন সমস্যা তাতে নেই। রুট বাউন্ড হয়ে গেলে, শেকড় মাটির ওপর উঠে এলে পঞ্চাশ শতাংশ শেকড় ছেঁটে এক সাইজ বড় টবে রি-পটিং করবেন। নতুন চারা যেভাবে রোপণ করার কথা বলেছি, সেই পদ্ধতিতেই রি-পটিং করবেন এবং তিন-চারদিন ছায়ায় রেখে তবে টবশুদ্ধ গাছ রোদে রাখবেন।
হালকা ছাঁটাই সারা বছরই করবেন। সারা মার্চ জুড়ে এই গাছের ডগা নখ দিয়ে ছেঁটে বা পিঞ্চিং করে নতুন শাখার সংখ্যা বাড়াবেন। বছরের অন্যান্য সময় ফুল ঝরে যাওয়ার পর শাখার মাথা নিয়মিত ছেঁটে ফেলে দেবেন। এতে নতুন শাখার সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়বে। মোট কথা, সব সময়ই চেষ্টা করবেন, যাতে গাছে নতুন শাখা বেশি বেশি করে তৈরি হয়। কেননা, এই গাছে যত শাখা বাড়ে, ফুলের পরিমাণও হয় ততই বেশি।