ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে রঙ্গন গাছে সারাবছর প্রচুর ফুল ফোটানোর বিশেষ উপায়

রঙ্গনের কোন গন্ধ নেই, তবু থোকা থোকা অপূর্ব সৌন্দর্যের জন্য সে অত্যন্ত জনপ্রিয় ফুল। সাদা, চন্দনী, হলুদ, লাল, ফিকে লাল, গোলাপি, হালকা গোলাপি, দুধ-আলতা—নানান রঙের হয়ে থাকে সে। রঙের বাহার ছাড়াও সখের বাগানীদের কাছে তার অতি-জনপ্রিয়তার আরও তিনটি কারণ রয়েছে; তা হল, এই গাছ সারা বছর ফুল দেয়, ফুল গাছে পনেরো-কুড়ি দিন তাজা থাকে এবং অত্যন্ত অল্প যত্নে এই গাছ প্রচুর ফুল দিয়ে থাকে।

পাতাভেদে রঙ্গন তিন রকমের হয়ে থাকে। ছোটপাতার রঙ্গন, বড়পাতার রঙ্গন ও গোলপাতার রঙ্গন। এই তিন জাতের রঙ্গনই খুব সুন্দরভাবে অল্প-বিস্তর যত্নে ব্যালকনি বা ছাদের বাগানে চাষ করা যায়। ছোটপাতার রঙ্গনের গাছ বেশ ঝাড় কেটে সুন্দর শেপ নিয়ে বাড়তে পছন্দ করে, এই জাতের ফুলের থোকা আকারে সামান্য ছোট হয়। বড়পাতার রঙ্গনের পাতা কিছুটা মাদার বা আমআতার পাতার মতো দেখতে হয়, এই গাছের ফুলের থোকাও বেশ বড় বড় হয়। তবে এই জাতের গাছ লম্বা লম্বা ডাল ছড়িয়ে বাড়তে পছন্দ করে, নিয়মিত ছাঁটাই করে এই গাছের শেপ ঠিক রাখতে হয়। গোলপাতার রঙ্গনের পাতা ছোট্ট বোঁটাযুক্ত হালকা সবুজ রঙের হয়ে থাকে। এই জাতের গাছের ডাল কিছুটা লতার মতো তরতরিয়ে বাড়ে। এই গাছের ফুলের থোকাও তুলনামূলকভাবে ছোট হয়। গাছের আকারের ভিন্নতা বাদ দিলে এই তিন জাতের রঙ্গনের মাটি, খাবার, রোদের চাহিদা, পরিচর্যা, বেশি ফুল পাবার উপায় সবই কিন্তু এক।     

উপযুক্ত মাটি কীভাবে তৈরি করবেন?

রঙ্গন ভেজা ও হালকা মাটি পছন্দ করে, শেকড়ের কাছাকাছি মাটির হালকা ভেজা ভেজা ভাবও তার পছন্দ; কিন্তু গোড়ায় জল জমা সে একদম পছন্দ করে না। কোকোপিটযুক্ত জৈবসারসমৃদ্ধ বেলে-দোআঁশ মাটি তাই তার জন্য একেবারে আদর্শ। এই ধরণের মাটি তৈরি করতে এক ভাগ এঁটেল মাটি, দেড় ভাগ সাদা মিহি বালি, এক ভাগ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং বাকি আধ-ভাগ কোকোপিট একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নেবেন (বাড়িতে পুরনো দোআঁশ মাটি থাকলে তার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বালি এবং আগের বলা পরিমাণে কোকোপিট ও জৈবসার মিশিয়ে নিলেই হবে)। তারপর এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে দেড় চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড, এক চামচ নিমখোল, এক চামচ হাড়গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নিলেই রঙ্গনের জন্য এক্কেবারে আদর্শ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রিপটিং-এর জন্য ব্যবহার করবেন।

কেমন টবে, কীভাবে চারা বসাবেন?

বছরের যে-কোন সময়ই রঙ্গনের চারা বসানো যায়। ছোট থেকে বড়, নানান আকারের চারা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। ছোট সাইজের চারা হলে প্রথমবার আট ইঞ্চির টবে বসাবেন, বড় হলে দশ ইঞ্চির টবে বসাবেন। বাজার থেকে পছন্দের জাতের চারা এনে বাড়িতে দিন-সাতেক রেখে দেবেন বাড়ির আবাহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। তারপর তাকে টবে বসাবেন। ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবের আশিভাগ আদর্শ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তাতে হাফ চামচ এপসম সল্ট সম্ভব হলে ছড়িয়ে দেবেন (সম্ভব না-হলে দরকার নেই), তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দেবেন।

কেমন রোদে রাখবেন? জল ও অন্যান্য খাবার কী পরিমাণ দেবেন?

রঙ্গন খুব কষ্টসহিষ্ণু গাছ। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদও সে অনায়াসে সহ্য করে নেয়। গোড়ায় জল না-জমলে টানা বৃষ্টিতেও তার কোন অসুবিধে হয় না। এমনকি কনকনে শীতও তাকে কাবু করতে পারে না। তবু টবের গাছে সারা বছর ভালো ফুল পেতে সঠিক পরিমাণ রোদ, সঠিক খাবার, প্রয়োজনীয় পরিচর্যা তাকে কিন্তু দিয়ে যেতে হবে।

রোদঃ রঙ্গন রোদ খুব ভালোবাসে। কমপক্ষে ছ’-সাত ঘন্টা রোদে এই গাছ ভালো ফুল দেয়।  সারা বছর এই গাছ ফুল দিলেও গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি ফুল দেয়। বছরের অন্য সময় এই গাছ সারাদিনের রোদ এনজয় করে। তবে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা রোদ আসে, এমন জায়গাতেই এর টব রাখবেন। এর চেয়ে বেশি রোদের এই সময় তার প্রয়োজন নেই। কেননা, গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরের ঠাডাপোড়া রোদ ও গরম বাতাস গাছ নিজে অনায়াসে সহ্য করে নেয় ঠিকই, কিন্তু ফুলের পাঁপড়ি পুড়ে যাওয়া আটকাতে পারে না। তবে গ্রীষ্মে যদি তাকে সারাদিনের রোদে রাখতেই হয়, তাহলে সকাল-বিকাল দু’বেলা জল তো দেবেনই, সঙ্গে স্নানও করাবেন। 

জলঃ মাটি যেহেতু বেলে-দোআঁশ, সেহেতু সারা গ্রীষ্মে সকালে গাছে জল দিলেও বিকেলে মাটি শুকিয়ে যাবে; তাই এই সময় দু’বেলা জল দেবেন। বছরের অন্যান্য সময় দিনে একবারই মাটি শুকনো শুকনো মনে হবে, তখন একবার জল দিলেই হবে। মোট কথা, ওপরের মাটি শুকোলেই টবে জল দেবেন, নতুবা দেওয়ার দরকার নেই। 

অন্যান্য খাবারঃ রঙ্গন গাছে তেমন রাসায়নিক সার দেবার দরকার নেই। দশদিন অন্তর খাবার হিসেবে এই গাছকে সরষের খোলপচা জল পাতলা করে দিয়ে যাবেন। কমপক্ষে তিনদিন সরষের খোল পচাবেন হাফ লিটার জলে এক মুঠো খোল দিয়ে। এবার এই পচানো খোলজলের সঙ্গে আরও তিন লিটার জল মিশিয়ে সেই জল যতটা প্রয়োজন রঙ্গনের টবে দেবেন; বাকিটা আপনার বাগানের অন্যান্য গাছে দেবেন বা বোতলে ভরে জমিয়ে রেখে দেবেন পরের বারের জন্য। সরষের পরিবর্তে বাদাম খোল দিতে চাইলে ঐ একইভাবে দেবেন; তবে এক্ষেত্রে শুধু একদিন পচাবেন। মাসে একবার টবের মাটিতে এক মুঠো ভার্মি কম্পোস্ট দেবেন। মাসে একবার এক চা-চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট টবের মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন। ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে পাতা হলুদ হওয়া ঠেকাতে, গাছ সতেজ রাখতে, ফুলের পরিমাণ বাড়াতে এটি খুবই সাহায্য করে। মাসে একবার দশ ইঞ্চি টবের জন্য এক চা-চামচ, আট ইঞ্চির জন্য তার চেয়ে সামান্য কম লাল পটাশ গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দেবেন। পটাশ নিয়মিত প্রচুর ফুল ফোটাতে সাহায্য করে। 

প্রচুর ফুল পেতে অত্যন্ত আবশ্যিক পরিচর্যা কোনটি?

প্রচুর ফুল পেতে আগের খাবারগুলোর সঙ্গে একটা জিনিস সপ্তাহে একবার আপনাকে দিতেই হবে; সেটা হচ্ছে মাছ বা মাংসের রক্তধোয়া জল। এটা সারা বছর ধরে নিয়মিত দিয়ে গেলে গাছের এমন একটা ডালও থাকবে না, যাতে কলি দেখা যাবে না। যাঁদের বাড়িতে মাছ বা মাংস রান্নার সমস্যা আছে, তাঁরা বাজার থেকে রক্তসার কিনে আনবেন; প্রতি কুড়ি দিন অন্তর এক চামচ করে টবের মাটি খুঁচিয়ে ছড়িয়ে দেবেন।

যে গাছে কিছুতেই ফুল আসছে না বা যে গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুল দিচ্ছে না; সেই গাছের মাটিতে ওভাবে মাছ-মাংসের রক্তধোয়া লালচে জল বা রক্তসার দিয়ে দেখুন, এক মাসের মধ্যে অবশ্যই প্রচুর কুঁড়ি আসবে।

প্রচুর ফুল পেতে আর একটা জিনিস করতে হবে, তা হল, গাছের ফুল ঝরে যাবার পর ফুলের বৃতিটা কেটে ফেলে দিতে হবে। এর ফলে পাতার কোল থেকে প্রচুর নতুন শাখা হবে। রঙ্গনের নতুন শাখার মাথায় মাথায় মুকুল আসে। ফলে যত নতুন শাখা বাড়ানো যাবে, এই গাছে তত বেশি ফুল পাওয়া যাবে।

রঙ্গন অম্ল মাটি পছদ করে। মাসে একবার এক মগ জলে এক চামচ ভিনিগার মিশিয়ে সেই জল দিলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ফুলের পরিমাণও বাড়ে।   

গাছকে রোগবালাই ও পোকামাকড় থেকে বাঁচানোর উপায় কী?

রোগবালাই রঙ্গনে তেমন নেই। কখনও কখনও সাদা মাকড় এবং পাতাখোর লার্ভাজাতীয় একধরণের পোকার আক্রমণ ঘটে। সাদামাকড় দেখলে থাইমেথোক্সাম-জাতীয় কীটনাশক তিন গ্রাম এক লিটার জলে গুলে স্প্রে করে দেবেন, তাতেই উপকার পাবেন। পাতাখোর লার্ভাজাতীয় পোকা সহজে চোখে দেখা যায় না; লুকিয়ে থেকে গাছের কচিপাতা ও ডগাগুলো খেয়ে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। বর্ষার শেষ থেকে পরের কয়েক মাস মূলত এই পোকার আক্রমণ হয়। ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল ও লাম্বডাসিহ্যালোথ্রিন-জাতীয় কীটনাশক এক লিটার জলে পাঁচ থেকে ছ’ফোঁটা মিশিয়ে স্প্রে করে দিন, পোকা মরে যাবে।

কাটাই-ছাঁটাই ও রি-পটিং কোন সময় করবেন?

সারা বছরই এই গাছের হালকা ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয়। ছোটপাতার গাছে শুধু ঝরাফুলের বৃতি ছেঁটে গেলেই হয়। বাকি দুটো জাতের গাছে বৃতি ছাড়াও বেঢপ ডাল ছেঁটে একইসঙ্গে গাছের শ্রী বজায় রাখতে ও নতুন ডালের সংখ্যা বাড়িয়ে বেশি ফুল আদায় করে নিতে হয়।

তবে তিনটে জাতের গাছেই প্রয়োজনে হার্ড প্রুনিং করবেন শীতে। কেননা, শীতে এই গাছে ফুলের পরিমাণ কম থাকে। তাছাড়া এই গাছ যেহেতু গরমে বেশি ফুল দেয়, তাই তার নিজের মধ্যেও শীতের শেষে নিজেকে সাজিয়ে তোলার প্রস্তুতি থাকে। ফলে, এই সময় সমস্ত কাটা-ছেঁড়া আঘাত সে অল্প সময়েই কাটিয়ে ওঠে।

রঙ্গনের রিপটিং বছরের যে-কোন সময়েই করা যায়, তবে উপরোক্ত কারণেই রিপটিং করারও উপযুক্ত সময় হচ্ছে শীতই। রুট বাউন্ড হয়ে গেলে, শেকড় মাটির ওপর উঠে এলে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর শতাংশ শেকড় ছেঁটে এক সাইজ বড় টবে রি-পটিং করবেন। আদর্শ মাটি তৈরি করে, টবের ড্রেনেজ ঠিক রেখে সেই মাটি কিছুটা দিয়ে তার ওপর এক চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর ছাঁটাই করা গাছটা বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর টবে কানাভর্তি জল দিয়ে এবং তিন-চারদিন ছায়ায় রেখে তবে টবশুদ্ধ গাছ রোদে রাখবেন।

নতুন চারা তৈরি করবেন কীভাবে?

তিন-চার ইঞ্চির ডাল থেকেও রঙ্গনের চারা খুব সহজেই করা যায়। কাটা ডাল বেলে মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাটি সবসময় হালকা ভেজা ভেজা রাখবেন। ব্যস, এতেই একমাসের মধ্যে নতুন চারা পেয়ে যাবেন।

          

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...