সনাতন হিন্দু ধর্মের লোকেরা যে পাঁচ প্রধান দেবদেবীর উপাসনা করেন তাদের মধ্যে গণপতি একজন। গণপতিদেব ছাড়া বাকি চারজন হলেন সূর্যদেব, মহাদেব, মা কালী ও ভগবান বিষ্ণু। এই পাঁচ ধর্মের উপাসকরা তাই গাণপত্য, সৌর, শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব রূপে পরিচিত। এখন এই পাঁচ সম্প্রদায়ের মধ্যে গণপতিদেব হলেন প্রথম পূজ্য দেবতা।
গণেশের উপাসনা ভৌতিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক সিদ্ধির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ। সকল দেবতার পুজোর প্রথমে তাঁর পুজো হয়। প্রথম পূজ্য এই গজানন সম্পর্কে মানুষের মনের মধ্যে তাই নানানরকম কৌতূহল সৃষ্টি হয়। তার স্ত্রীর নাম কী, তার সন্তান কারা, তার আবির্ভাবের রহস্য এবং তার মুন্ডু কীভাবে গজ মুন্ডু হলো-এই বিষয়গুলি সম্পর্কে মানুষের মনে একটা আবছা ধারণা রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধিদাতা গণেশের সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্তারিতভাবে জানতে সকলে উৎসুক হয়ে থাকেন।
শাস্ত্র বলে গণেশের দুজন স্ত্রী আছেন। তাদের নাম ঋদ্ধি ও সিদ্ধি। গণেশের দুই পুত্রের নাম শুভ ও লাভ। বিঘ্নহর্তা গজাননের কৃপায় ব্যক্তির যেমন সকল কাজ নির্বিঘ্ন হয়, তেমনি ঋদ্ধি-সিদ্ধির আশীর্বাদে একজন ব্যক্তি যশ, বৈভব ও প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হয়। সনাতন শাস্ত্রে গণেশকে বুদ্ধিদাতা বলা হয়, আর এই বুদ্ধিকে প্রস্তুত করবার পবিত্র চিহ্ন হল স্বস্তিক। বলা হয় যে স্বস্তিক এর মধ্যে যে দুই পৃথক রেখা টানা হয় তা গণেশের দুই স্ত্রী ঋদ্ধি-সিদ্ধির প্রতীক স্বরূপ। অন্যদিকে ঋদ্ধি শব্দের অর্থ বুদ্ধি অর্থাৎ শুভ, আবার সিদ্ধি শব্দের অর্থ আধ্যাত্বিক শক্তির পূর্ণতা অর্থাৎ লাভ। তাই লক্ষ করে দেখবেন প্রত্যেকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বা বাড়ির প্রবেশদ্বারের ওপরে মধ্যভাগে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হয় ও স্বস্তিকের ডান ও বাম দিকে শুভ ও লাভ লেখা হয়।
গণেশের এই দুই স্ত্রী লাভের পিছনেও গল্প আছে। শোনা যায় যে তুলসী দেবী একবার গণেশের সুন্দর রূপ দেখে তাকে ভগবান বিষ্ণু ভেবে ভুল করেছিলেন ও তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু গণেশ এই প্রস্তাব নাকচ করে জানান যে, তিনি যাকে বিয়ে করবেন তাকে মাতা পার্বতীর মতো গুণসম্পন্না হতে হবে এবং মাতা পার্বতী যেমন মহাদেবের সেবা করেন তেমনভাবে সেবা করতে হবে। তখন তুলসী দেবী গণেশের ব্যবহারে আহত হয়ে গণেশ কে অভিশাপ দেন যে, তার অপছন্দের পাত্রীকেই তাকে বিয়ে করতে হবে। অন্যদিকে গনেশ তুলসী দেবীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তুলসী দেবী অসুর পত্নী হবেন। কথিত আছে এই বিবাদের কারণেই গণেশ পুজোয় তুলসী পত্রের ব্যবহার হয় না।
গণেশের বৌ সম্পর্কে আরও একটি ধারণা আছে যে কলা বউ নাকি গণেশের স্ত্রী। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি মত। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন কলা বৌ আসলে গণেশের স্ত্রী নন, তিনি গণেশ জননী অর্থাৎ দুর্গা।
গণেশের আবির্ভাবের গল্পটি হল - একদিন কৈলাসে দেবী পার্বতী স্নান করতে যাওয়ার আগে দ্বাররক্ষী হিসেবে নন্দীকে পাহারায় রেখে গিয়েছিলেন। এই সময় সেখানে মহাদেব আসেন ও তিনি ভিতরে প্রবেশ করতে চান। মহাদেবের বাহন নন্দী, তাই নন্দী প্রভুকে বাধা দিতে পারেন না, পথ ছেড়ে দেন, মহাদেব ভেতরে প্রবেশ করেন। এই ঘটনা দেখে পার্বতী রেগে যান, তিনি বুঝতে পারেন যে কৈলাসে তার অনুগত কোনো গণ নেই, সকলেই মহাদেবের অনুগত। তখন তিনি একটি সন্তানের প্রয়োজন অনুভব করেন ও তার প্রসাধনের কিছুটা হলুদ মাখা দিয়ে সৃষ্টি করেন এক মূর্তির ও নিজের শক্তি দিয়ে তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি পার্বতী পুত্র গণেশ।
গণেশের সৃষ্টির পর পার্বতী তাকে কৈলাসের দ্বার পাহারা দিতে বলেন। পার্বতী যখন গণেশের সৃষ্টি করেছিলেন তখন কৈলাসে মহাদেব ছিলেন না তাই গণেশের জন্মের বিষয়ে মহাদেব কিছুই জানতেন না। আবার গণেশও তার বাবার বিষয়ে কিছু জানতেন না। গনেশকে কৈলাসের দ্বার রক্ষার কাজ দিয়ে পার্বতী ভেতরে চলে যান, ইতিমধ্যে মহাদেব সেখানে আসেন। তিনি ভিতরে ঢুকতে চাইলে গণেশ তাকে বাধা দেন। মহাদেব যতবারই গণেশকে ভেতরে প্রবেশ করবার কথা বলেন ততবারই গণেশ জানান, তিনি মাতৃ আজ্ঞা ভিন্ন কাউকেই ভিতরে ঢুকতে দেবেন না। এতে ভোলানাথ মহাদেব রুষ্ট হয়ে যান।
গণেশ ও মহাদেব একে অপরের পরিচয় না জেনেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন। একসময় ভোলানাথের ত্রিশূলে গনেশের মাথা কেটে যায়, পার্বতী ফিরে এসে দেখেন ছেলের মাথা মহাদেব কেটে দিয়েছেন! তিনি ক্রোধে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। এর ফলে প্রলয় আসন্ন হয়ে ওঠে, তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিজে এসে পার্বতীর কাছে ক্ষমা চান, দেবীকে শান্ত হতে বলেন। কিন্তু দেবী জানান, তিনি দুটি শর্তেই ক্ষমা করতে রাজি আছেন, যদি গণেশের প্রাণ ফেরত দেওয়া হয় এবং সকল দেবতার আগে তার পুজোর প্রবর্তন করা হয়। মহাদেবও দেবীর এই শর্তে রাজি হয়ে যান।
মহাদেব তখন ব্রহ্মাকে বললেন উত্তর দিকে গিয়ে যে প্রাণী সবার আগে দেখতে পাবেন, তার মাথা কেটে আনতে। ব্রহ্মা উত্তর দিক বরাবর গিয়ে সবার প্রথমে হাতির মাথা দেখতে পেলেন, তিনি সেটি নিয়ে এলেন। মহাদেব গণেশের শরীরে গজের মুখ লাগিয়ে দিলেন, জ্ঞান ফিরতেই তিনি গনেশকে পুত্রস্নেহে কাছে টেনে নিলেন এবং সবার আগে গণপতির পুজোর বিধি প্রবর্তন করলেন, সকল দেবতাও খুশিমনে এই কথা মেনে নিলেন। একই সাথে মহাদেব গণেশকে তার সকল গনদের অধিপতি হিসেবে নিযুক্ত করলেন, গনদের অধিপতি হিসেবে গণেশ হলেন গণপতি।
গণেশের গজমুন্ড তো হল, কিন্তু গণেশের কাটা সেই মনুষ্য মুন্ডটি কোথায় গেল? এই বিষয়ে কথিত আছে যে পাতাল ভুবনেশ্বর গুহাতেই গণেশের আসল মস্তক রয়েছে। উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড়ে এটি অবস্থিত। কথিত আছে স্বয়ং মহাদেব এটি পাহারা দেন। আবার এই গুহায় যে কোন মানুষ একবারই প্রবেশ করতে পারেন, তাই কোনও ব্যক্তি যদি এই গুহায় প্রবেশ করে কোনও কারণে গণেশের মস্তক দর্শন না করে ফিরে আসেন তাহলে তাকে দ্বিতীয়বার আর গুহার ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় না।
এই মন্দিরে একটি শিলারূপী পাথর আছে, এটিকে গণেশের মস্তক বলা হয়। গণেশের এই শিলা মস্তকের উপরে ১০৮টি পাপড়ি দেওয়া ব্রহ্মকমল আছে যা ভগবান শিব স্থাপন করেছিলেন। এই ব্রহ্মকমল থেকে বিন্দু বিন্দু আকারে জল যখন শিলার ওপর পড়ে, তখন তা দেখে মনে হয় ভগবান গণেশের মুখের ভেতর যেন সেই জল পড়ছে। আবার এই গুহাতে কলিযুগরূপী একটি পাথর আছে যেটি দিন দিন উপরে উঠছে! কথিত আছে এই পাথর যেদিন গুহার দেওয়াল স্পর্শ করবে সেদিন কলিযুগ ধ্বংস হবে। বলা হয় যে, এই মন্দিরের গুহার দেওয়াল ধরে হাঁটলে অশেষ পূণ্য অর্জিত হয়।