কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর জাঁক-জমকের কাহিনি আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে কলকাতার বনেদি বাড়িগুলো ফিরিঙ্গিদের তোষামোদ করার জন্য দুর্গাপুজোকে বেছে নিতেন। ফলে পুজো ঘিরে শুরু হত রেষারেষি। কে কত বেশি ঠাট বাট দেখাতে পারবে, তার নিয়ে ছিল প্রতিযোগিতা। ফিরিঙ্গিরাও সেগুলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেন এবং পুজোগুলোকে নিজেদের উদ্দেশ্য ব্যবহার করতেন। তাঁদের সঙ্গ দিতেন কলকাতার রাজা বাহাদুররা।
সবে কিছুদিন হয়েছে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সিরাজদৌল্লা পরাজিত। বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়ের নিশান উড়িয়েছেন কর্ণেল ক্লাইভ। যুদ্ধ জিতে হয়ে উঠলেন লর্ড ক্লাইভ। গভর্নরের দেওয়ান রামচাঁদ মুন্সি হলেন নবকৃষ্ণ। বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হল। আমন্ত্রিত করা হল লর্ড ক্লাইভকে। সেই পুজোকে পলাশী যুদ্ধের বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে পালন করা হল।
নবকৃষ্ণ দেবের দুর্গাপুজোয় ক্লাইভের আগমনের কথা মনে রেখে 'কলিকাতার ইতিবৃত্তে' প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখেছিলেন- "মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর পলাশী যুদ্ধ হইতে ফিরিয়া আসিয়া ঘোর ঘটায় দুর্গোৎসব করিবার জন্য উত্তরের রাজবাটী এত সম্বর নিমার্ণ করিয়াছিলেন যে শুনিলে আশ্চর্য হইতে হয়। তাঁহার দুর্গোৎসব উদ্বোধন হইতে বাইনাচ আরম্ভ হইত, তাহা দেখিবার জন্য শহরে বড় শহরের বড় বড় সাহেব নিমন্ত্রণ হইতেন এবং এখনও হন। সাহেবরা এই নৃত্যোৎসবকে পলাশী যুদ্ধজয়ের স্মৃতি-উৎসব বলিয়া সাদরে যোগদান করিতেন এবং আজিও করেন"। লর্ড বেন্টিকও দুর্গাপুজোর আসরে যেতেন।
সেকালে দুর্গোৎসবে বাই নাচের কথা সর্বজনবিদিত। সেখানেও ফিরিঙ্গদের প্রভাব পড়েছিল। দেশি নর্তকী ঠিক মানানসই নয়। তাই প্রমোদ বৈচিত্র্য আনার জন্য রাধাকান্ত দেব আনলেন মেম নর্তকী। ১৮৫৫ সালে শোভাবাজার দুর্গাপুজোর দিনে মেম বাইজি আনা হল। যাঁর এক রাতের দক্ষিণা দুশো টাকা ছিল। কালা আদমির মনোরঞ্জনে শ্বেতাঙ্গিনী এল। গোটা শহরে তার নিয়ে ঢি ঢি পড়ে গেল।
অক্টোবরের ১৩ তারিখ সেকালের সাহেবি কাগজ 'মর্নিং ক্রনিকলে' খবর ছাপা হয়েছিল। শোভাবাজার রাজবাড়িতে মেম বাইজির নাচ দেখার টিকিটের জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছে। গাদা গাদা লিখিত আবেদন প্রতিদিন জমা পড়ছে অগুন্তি। ফিরিঙ্গি সাহেবদের চোখে দুর্গাপুজো 'কিওরিসিটি' উদ্রেক করেছিল।
শুধু বাইনাচে মেম নয়, খানা-পিনাও আসত বিলিতি দোকান থেকে। রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে উইলসনের দোকানের বিলিতিখানা পুজোর সময় অতিথিদের পেট ভরাত। বিসর্জনের সময়ও বিলিতি বাদ্য ছাড়া চলত না। কলকাতার বেশিরভাগ বনেদি পরিবারে পুজোয় বিলিতি গড়ের বাদ্য এনে বিসর্জন দেওয়া হত।
পিটার নামের এক ফিরিঙ্গি সাহেবের জিমন্যাস্টিক দল শোভাবাজারের রাজবাড়িতে দুর্গা দালানে ট্রাপিজ রিং, হরাইজন্টাল বার, গ্রাউন্ড এক্সারসাইজ প্রভৃতি কসরত করে দর্শকদের মুগ্ধ করতেন। নবগোপাল মিত্র পিটারের জিমন্যাস্টিক দেখে মুগ্ধ হয়ে বাঙালি ছেলেদের জিমন্যাস্টিক শেখানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
১৭৯৯ সালে বেলজিয়ামের এক চিত্রকর কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় বসে দুর্গাপুজোর ছবি এঁকেছিলেন। সেই বোধহয় ফিরিঙ্গিদের চোখে দেখা প্রথম দুর্গা চিত্র। এই ছবিতে একচালায় তিন খিলানের নিচে দাঁড়িয়ে তিনদেবী। মধ্যে দুর্গা। দু'পাশে দুর্গা-সরস্বতী। দেবী দশভুজার দীঘল আদলের মুখ। দশটি হাত তবে বাঁ হাতে ধরা ত্রিশূল। দেবীর চেহারায় দৈবভাব নেই। শীর্ণসুন্দরী এক বিদেশিনীর ছায়া যেন তাঁর মুখে।
একসময় কলকাতার দুর্গাপুজো ফিরিঙ্গিদের মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ইংরেজদের মোসাহেবি করার জন্য দুর্গাপুজোকে বেছে নেওয়া হতো। তাই পুজোর সর্বত্র ছিল ফিরিঙ্গিদের প্রভাব।