একমাথা কালো কোঁকড়া চুল, ফোলা গাল। ওই রিং-রিং চুলের জন্য কাছের মানুষরা ‘ম্যাগি’ বলে ডাকে। দেখতে যতই বাবলি হোক, পর্দায় তিনি মোটেই নরমসরম নন। প্রথম নজর কেড়েছিলেন সুজিত সরকারের ‘পিঙ্ক’ ছবিতে। শুধু নজর কাড়া নয় যাকে বলে হইচই ফেলা দেওয়া।
২০১৬ সালে ‘নো মিনস নো’ হয়ে উঠেছিল দেশের গোটা দেশের মেয়েদের মুখের কথা। কর্মক্ষেত্র হোক না বাড়ির কোণ না মানে নাই। এমন স্বর আগে কোনওদিন শোনা যায়নি। সিনেমার সংলাপ ছড়িয়ে পড়েছিল আগুনের মতো।
সেরা চলচ্চিত্রের সম্মান পেয়েছিল ছবি। পিঙ্ক ছবির তিন কন্যের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতমা। তাপসী পান্নু।
দিল্লির অশোক বিহারেরর মাতা জয় কাউর স্কুল থেকে শেষ করেন পড়াশোনা। আর পাঁচটা কেরিয়ারমুখী ছেলেমেয়ের মতোই মেধাবী তাপসী স্কুল শেষের পরীক্ষা দিয়ে ভেবেছিলেন পরের ধাপ ইঞ্জিনিয়ারিং, তারপর ক্যাম্পাসিং, তারপর প্লেসমেন্ট, ড্রিম জব। সেভাবেই এগোচ্ছিল কেরিয়ার। দিল্লির গুরু তেঘবাহাদুর ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তিও হন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রী হিসেবে। পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয়ের নেশাটাও ছিল, কিন্তু তা নিয়ে কখনই খুব সিরিয়াস হননি। আসল ফোকাস পড়াশোনাতেই। কলেজের দিনগুলোতে ‘ফন্ট সোয়াপ’ নামে একটি অ্যাপও তৈরী করেছিলেন।
জীবনের প্রথম চাকরিটা পেয়েছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবেই। তারপর এমবিএ-এর এন্ট্রেস। ২০০৮ সালে হঠাৎই মডেলিং-এ আসা। একটি টিভি শো’র মাধ্যমে। ওই বছরের ফেমিনা মিস ইন্ডিয়ার মঞ্চে নজর কেড়ে নেন। তখনও আন্দাজ ছিল না ঠিক ১০ বছর পর বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিচারে দেশের সেরা ১০০ সেলিব্রিটির মধ্যে জায়গা করে নেবেন তিনি। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমান ১৫.৪৮ কোটি টাকা।
অথচ ছোটবেলাটা ছিল একেবারেই সাদামাটা। দিল্লির আর পাঁচটা সাধারণ পঞ্জাবি পরিবার যেমন হয় ঠিক তেমনি। বাবা-মা আর দুই বোন এই নিয়ে পরিবার। হোমওয়ার্ক আর স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি কত্থক আর ভরতনাট্যমের ক্লাসে যেতেন নিয়ম করে। এখানটাতেই শুরু থেকে তাপসী বেশ অন্যরকম। প্রতিযোগীতাতেও অংশ নিতেন।
প্রথম ছবি ডেভিড ধাওয়ানের পরিচালনায় ‘চসমে বদ্দুর’। ‘পিঙ্ক’, ‘নাম শাবানা’, ‘অ্যান্ড’, ‘থাপ্পড়’, একের পর এক চোখ টেনে নেওয়া ছবি। সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। নানারকম চরিত্রে চালিয়েছেন পরীক্ষানিরিক্ষা।
পর্দার তাঁর অভিনীত একরোখা জেদি চরিত্রগুলোর সঙ্গে কতটা মিল আছে বাস্তবের তাপসী। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ আমার বাবা বলেন আমি বড্ড তর্ক করি, যে কোনও বিষয় নিয়ে এত প্রশ্ন করি যে বাবা একসময় বলত তু লইয়ার বন জা’। নাহ, আইনজীবী হননি তাপসী, কিন্তু বজায় রেখেছেন তাঁর যুক্তি-তর্কের স্বভাব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঠিক আর ভুল নিয়ে তাঁর মতামত আর অবস্থান দুই খুব স্পষ্ট।
বাড়িতে সিনেমার চর্চা বলতে শুধুই সিনেমা দেখা, সাধারণ ভারতীয় জীবনে যেমন হয়। তাঁর পরিবারেরই কেউ কোনওদিন ভাবেনি যে পরিবার থেকে কেউ সিনেমার পেশায় আসবে। তাই অন্য সব কিছু ছেড়ে সিনেমাকেই জীবন ভেবে নিতে ডেডিকেশন আর স্ট্রাগল ছাড়া আরও কোনও অস্ত্র ছিল না তাঁর কাছে। ‘নেভার সে নেভার’ এই একটা লাইনকে সর্বক্ষণের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। চলতে ফিরতে মন্ত্রের মতো আওড়াতেন।
তাপসীর বাবা-মা কখনও বাধা দেননি তাপসীকে। তিনি জানতেন সিনেমায় যদি সফল হতে নাও পারেন অন্য কিছুতে ঠিক সাফল্য আসবেই। জীবন থেমে থাকবে না।
তাপসীর সম্পদ তাঁর আত্মবিশ্বাস। কোনও কিছুই করার জন্য করেন না। প্রতিটা বছর জীবন তাঁর জন্য যতটা সময় বরাদ্দ রেখেছে সবটুকুকেই কাজে লাগাতে চান। তাই তাঁর কোনও ‘মানডে ব্লুজ’ নেই। ‘ওয়ার্ক এথিকস’ তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই আদর্শ তিনি শিখেছেন তাঁর সিনিয়র, অক্ষয়কুমারের কাছ থেকে। একবার তাঁর কেরিয়ারেও এসেছিল লম্বা ব্যাডপ্যাচ। একটার পর একটা ছবি ফ্লপ। অক্ষয় ভেবেছিলেন তাঁকে বোধহয় ইন্ড্রাস্ট্রি ছাড়তে হবে। কিন্তু যেসব প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছিলেন তাঁরা অক্ষয়ের কাজের আদর্শ, ভদ্রতা, সততায় তাঁর প্রতি বিশ্বাস হারাননি। অক্ষয় ফিরেছিলেন সাফল্যের পথে।
ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মিতালী রাজের বায়োপিক ‘সাবাস মিঠু’তে পুরোদস্তুর মিতালী হয়ে উঠতে সেই ডেডিকেকেশন আর অধ্যাবসায়কেই কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। সেভাবে কোনওদিন ক্রিকেট খেলেননি। কিন্তু এই ছবির জন্য মাঠে নেমে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার ট্রেনিং নিয়েছেন। সারাক্ষণ প্যাড-গ্লাভস করে থাকতেন অভ্যাসের জন্য। ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হোক না হোক অভিনেত্রী হিসেবে যে তিনি সফল এ নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।