"ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম লক্ষণ বুকে আছে করবি আমার কি!" এ ছড়া কেটে বাঙালির ছেলেপুলেরা বড় হয়েছে। রামরাজাতলা, রামপুরহাট এই জায়গাগুলোর নামই বলে দেয়, বাংলার সঙ্গে রাম নাম কতটা সম্পৃক্ত। রামরাজাতলা, প্রায় ৩০০ বছর আগে সেখানকার জমিদার ছিলেন অযোধ্যারাম চৌধুরী। তিনি স্বপ্নাদেশ পান রামচন্দ্রের পুজো করার। বিশালাকার রামসীতার মূর্তি তৈরি করে পুজো শুরু করতে উদ্যোগী হন তিনি। সরস্বতী পুজোর দিন নিকটস্থ ষষ্ঠীতলার নির্দিষ্ট বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে সূচনা হয় রামপুজোর। রামের মূর্তির উপরে থাকে পাঁচটি সরস্বতী দেবীর মূর্তি। এছাড়াও শিব, ব্রহ্মাসহ প্রায় ২৬টি দেবেদেবীর মূর্তি থাকে এই বিশালাকার রাম ঠাকুরের মূর্তিতে। মূর্তিটি প্রায় দু'তলা বাড়ির সমান উঁচু হয়। আর এই রাম ঠাকুরের নাম থেকেই এই জায়গাটির নামও হয় রামরাজাতলা। রামরাজার পুজো এই অঞ্চল তথা হাওড়ার এক বিশেষ উৎসব। রামঠাকুরের জন্য রয়েছে স্থায়ী মন্দির।
প্রথমে রামপুজো হত তিনদিন ধরে, পরে তা বেড়ে পনেরদিন হয়, তারপর তা মাসজুড়ে চলতে আরম্ভ করে। এখন রামনবমীর দিন পুজো শুরু হয় এবং প্রায় চার মাস পর শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার এক বিশাল শোভাযাত্রা করে রাম ঠাকুরের বিসর্জন করা হয়। এই চারমাস ধরে রামতলায় রামমন্দিরের সামনে বসে মেলা। রাম ঠাকুরের সঙ্গেই এখানে পূজিত হন দশাবাতার, সাবিত্রী-সত্যবান ও মহাবীর। সুদীর্ঘ সময় যাবৎ বাংলায় রাম আরাধনা চলছে। আজ রামনবমী। হালে রামনবমী বাংলার উৎসব হয়ে উঠছে। আমাদের প্রবাদে রাম, প্রমাদ বলার অভিব্যক্তি প্রকাশ্যে জিভ কেটে এ রাম! পালা কীর্তনে একটু একটু করে রামায়ণের কাহিনী ছুঁয়ে যাওয়া। কিন্তু বাংলায় রাম দীর্ঘকাল ধরেই ছিল, এদেশীয়দের অনেকেরই আরাধ্য দেবতা রঘুবীর, সেও তো রাম। মহাপ্রভুর সংকীর্তনেও রাম নাম কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব - রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষ মাম্। রামের পুজো অনেক আগে থেকে হয়ে এসেছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে, কাটোয়া মহকুমায় প্রায় কুড়িটি রামের মূর্তি আছে। এছাড়া বাঁকুড়ায় রাম মন্দির পাওয়া যায়। রাঢ়বাংলায় রামকে নিয়ে অনেক মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম রামকে নিয়ে অনেক গান লিখেছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সারদা মা, রাণী রাসমণি, মুরারি গুপ্ত, চৈতন্যজীবনী লেখক দয়ানন্দ-সহ অনেকেই রঘুবীরের আরাধনা অর্থাৎ রামের পুজো করতেন। খাস কলকাতার বুকেও দাঁড়িয়ে আছে রামমন্দির, এমনকি আজকাল তা বাসের স্টপেজ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে।
রামায়ণ সাতটি খন্ডে বিভক্ত, ২৪,০০০ শ্লোক নিয়ে সে এক অতিকার মহাকাব্য। রামায়ণ ভারতের নানান ভাষায় রামায়ণ রচিত হয়েছে, অনুদিত হয়েছে; কাহিনীও বদলে গিয়েছে নিজের মতো করে। বাল্মীকির রামায়ণে রাম পুরুষোত্তম রাম। সে একজন ক্ষত্রিয় রাজপুত্র, সে বীর। অনেক পরে এক-আধবার তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। যদিও তিনি নিজে নিজেকে দশরথপুত্র বলেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। রামচন্দ্রের উত্তর জীবন এবং খোদ বাল্মীকি রামায়ণের উত্তর কাণ্ড, এই দুটি নিয়ে খুব একটা বলা যায় না৷ রামায়ণে রাবণ-বধের পর রামচন্দ্রের জীবন নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। তুলসী দাস আবার অন্য এক রামকে এঁকেছেন। বাঙালির রাম গড়েছেন কৃত্তিবাস, তাঁর রাম পাঁচালি অর্থাৎ কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা বাঙালির রামায়ণ অনুযায়ী, রাম এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নারীদের সম্মান দেন। বাঙালির রাম আসলে ফুলিয়া বা নদিয়ার শ্রী রামচন্দ্র। তিনি কখনও তাঁর স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেননি। যে রামের আজ চল হয়েছে, তাঁর সঙ্গে বাঙালি রামচন্দ্রের তুলনা করা যায় না। বাঙালির রাম মানেই নিঃস্বার্থ ভালবাসা। সীতাকে হারিয়ে রাম দিশেহারা, কেঁদে কেঁদে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন।
বিলাপ করেন রাম লক্ষ্মণের আগে।
ভুলিতে না পারি সীতা সদা মনে জাগে।।
সীতাকে হারিয়ে বনের লতা, পশুপাখিকে প্রশ্ন তিনি করেন, কেঁদে ভাসান- 'সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী'। একজন রাজ্যাহত রাজপুত্র সে, আদিবাসী-উপজাতি নিয়ে স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যান। বাঙালি দেবী-দেবতার তিনটি প্রধান ধারা। বৈষ্ণব, শাক্ত এবং শৈব। তাই রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা এবং কালীমন্দির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। বাঙালির সেরা পার্বণকে এককথায় বলা হয় দুর্গোৎসব, শারদীয়া অর্থাৎ অকালবোধন। কী আশ্চর্য, এই পুজো স্বয়ং রামচন্দ্র করেছিলেন।
বাঙালি রামকে চিনেছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। সে দেবতা নয়, মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ, এক সর্বগুণসম্পন্ন রাজকুমার, পুরাণের আদর্শ নায়ক। সৎমার ষড়যন্ত্রে রামকে বনবাসে যেতে দেখে বাঙালি দুঃখ পায়, কুঁজি মন্থরার পরিণতি দেখে আনন্দ পেয়েছে। এক পুরুষের হাতে সূর্পনখার নাক-কান কাটা গেলেও বাঙালি বিচলিত হয়নি – ও যে রাক্ষসী, মানুষ তো নয়। প্রতিপদে চোখে পড়ে বাঙালির রাম অলৌকিক শক্তিধারী দেবতা নন; বরং মানবিক গুণে ভুলত্রুটি এবং বীরত্বের মিশেলে তৈরি গড়ে ওঠা আমাদের কাছের লোক। রামের দুঃখে বাঙালি কাঁদে।
আবার সীতার অগ্নিপরীক্ষার সময়। বাঙালির সহানুভূতি সীতার দিকে। একইভাবে আমরা কষ্ট পাই প্রিয় নায়ককে রাজ্যের প্রতি দায়িত্ব এবং স্ত্রীর প্রতি ভালবাসায় দ্বিধাবিদীর্ণ হতে দেখে। রামের মধ্যে বাঙালি নিজের দুর্বলতা দেখে, মিল খোঁজ। এখানেই রাম আমাদের লোক। সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন, কিন্তু অক্ষত থেকে গিয়েছে মানবিক সত্ত্বা। সে অনুতপ্ত হয়, বিরহে ভেঙে পড়ে, মুখ বুজে সহ্য করে। এতো আমাদেরই একজন। মনে রাখতে হবে রাম লঙ্কা দখল করতে রাবণকে হত্যা করেননি, স্ত্রীকে উদ্ধার করতেই তাঁর লড়াই। অর্থাৎ সে আগ্রাসী নয়। রাবণ বধের পরে সে মন্দদরীর কাছে ক্ষমা চায়, রামশ্বরমে এসে ব্রাহ্মণ হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করে। এগুলো তো কোনটাই আগ্রাসী নয়। রাম লড়েন বানর সেনা নিয়ে, (বা: +নর) বানর অর্থাৎ পশু নয়, আদিবাসী উপজাতিদের নিয়ে সে লড়াই করেছিল। সেই রঘুপতি রাম।
বাঙালির রামচন্দ্র মহাকাব্যের নায়ক, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে চৌদ্দ বছরের জন্য ওঁকে বনবাসে যেতে হয়। কোথায় দেবত্ব? কোথায় ঐশ্বরিক মহিমা?
বাল্মিকী রামায়ণ এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের মধ্যে পার্থক্যই রামকে ঘিরে, তলোয়ার দিয়ে শূদ্রক তপস্বী হত্যার গল্প গৌরবের সঙ্গে বাল্মিকী রামায়ণে আছে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে নেই। কারণ, বঙ্গে ঐতিহাসিক কারণে জাতিভেদের তীব্রতা অনেক কম। সীতার পাতাল প্রবেশের পরে রামচন্দ্র কাঁদলেন। পৃথিবী দেবী তত ক্ষণে তাঁর দুখিনী কন্যাকে কোলের সিংহাসনে বসিয়ে অন্তর্হিত। রামচন্দ্র সীতার চুল টেনে পতাল প্রবেশ রোধের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রাবণবিজয়ী এই চেষ্টায় ব্যর্থ হন।
কৃত্তিবাসের বর্ণনায়, "পাতালে যেতে রাম ধরেন তাঁর চুলে
হস্তে চুলমুঠা রৈল সীতা গেল তলে।"
বাল্মীকির রাম আবার তেজি, স্ত্রী উধাও হওয়ার পরে সে একটু ক্ষাত্রতেজ দেখিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবীকে হুমকি দিলেন, "তুমি সীতাকে শীঘ্র ফিরিয়ে দাও। নইলে পর্বত আর অরণ্যসহ তোমাকে বিনষ্ট করব। দরকারে পৃথিবী জলময় হয়ে যাক!"কৃত্তিবাসী রাম নিরীহ, নিপাট বাঙালি সে স্ত্রীকে ফেরানোর চেষ্টা করেন মাত্র, আর পাঁচটা বাঙালির মতোই আর বাল্মীকির রাম পরাক্রমী। বঙ্গে রামযাত্রা হয় অল্পস্বল্প, কিন্তু তাতে অলৌকিক ক্ষমতাশালী বিষ্ণুর অন্যতম অবতার রামের চাইতেও ফুটে ওঠে দোষে গুণে ভরপুর ট্র্যাজিক নায়কের ছবি। রবীন্দ্রনাথের কলমেও– 'হনুমানকে যত্ন করে খাওয়াই দুধে-ভাতে, লক্ষ্মণভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে'। কাছের মানুষ বলেই রামকে নিয়ে মস্করা করতে আমাদের বাধে না। সুকুমারের লক্ষণের শক্তিশেল পড়েননি? মাইকেল নায়ক রাবণ, ভিলেন রামচন্দ্র নিয়ে 'মেঘনাদবধ কাব্য' লেখেন। বাংলায় সব দেবতার স্তোত্র-পাঁচালি কিছু না কিছু একটা আছে, কিন্তু রামের স্তোত্র বাঙলায় নেই। এমনকি অষ্টোত্তরশতনামও নেই! একাদশীর দিনে রামকৃষ্ণ মিশনে গাওয়া হয়-
"শুদ্ধব্রহ্মপরাৎপর রাম,
কালাত্মকপরমেশ্বর রাম,
শেষতল্পসুখনিদ্রিত রাম,
ব্রহ্মাদ্যমর প্রার্থিত রাম"।
যা সংস্কৃতে লেখা, বিবেকানন্দের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের পর এটি বাংলায় এসেছে।
মন জপ নাম শ্রী রঘুপতি রাম
নব দুর্বাদল শ্যাম নয়নাভিরাম।।
সুরাসুর কিন্নর যোগী মুনি ঋষি নর
চরাচর যে নাম জপে অবিরাম।।
সজল জলদ নীল নবঘন কান্তি
নয়নে করুনা আননে প্রশান্তি।
নাম স্বরনে টুটে যায় শেকতাপ ভ্রান্তি
রুপ নেহারি মুরছিত কোটি কাম।।