চৈত্র সংক্রান্তি তথা, চড়ক বা গাজনের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সঙ-সংস্কৃতি। সঙ কথাটির অর্থ কৌতুকাভিনেতা বা ভাঁড়। কিন্তু বঙ্গদেশে সঙ হয়ে উঠেছিল লোকনাট্য যা উৎসব, পালা-পার্বনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। চৈত্রের গাজনকেই সঙের উৎপত্তিস্থল হিসেবে মনে করা হয়। সঙ পালা সঙ যাত্রা বা সঙ খেলা নামেও পরিচিত৷ এক সময়ে দুই বঙ্গেই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সঙ৷ অনেক গ্রামেই সঙ যাত্রার দল থাকত৷ গ্রামে গ্রামে শিব-দুর্গা সেজে পৌরাণিক কাহিনী বলতে বলতে সঙের পালা চলত। সে সময় সঙের পালায় লিখিত কোনও পাণ্ডুলিপি থাকত না৷ দলের শিল্পী, কলা-কুশলীরাই মুখে মুখে সঙের কাহিনী, গান তৈরি করতেন৷ অভিনেতারাও ইচ্ছেমতো সাজসজ্জা করে, পোশাক পরে আসরে বা শোভাযাত্রায় যোগ দিতেন৷ সাধারণত সমসাময়িক কোনও ঘটনাকে উপজীব্য করেই হাস্যরস, মূলক কাহিনি এবং গান তৈরি হয়৷ গ্রামাঞ্চলের এই সব উৎসবের জন্ম প্রান্তিক, অন্ত্যজ সমাজেরই হাত ধরে। নানারকম পোষাক পরে, রঙ মেখে, নানান সাজে সেজে, গান, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদির দ্বারা সঙ পরিবেশন করা হত। কলকাতাতেও জাঁকিয়ে বসেছিল সঙ। উনিশ ও বিশ শতকের জিনিস আজ একেবারেই লুপ্ত। জীবন-জীবিকার সন্ধানে নিম্নবিত্ত মানুষজনরা কলকাতায় এসে জমিদার বাড়িগুলোর আশেপাশেই বসতি তৈরি করেছিল। জমিদারদের উৎসাহ ও আর্থিক সাহায্যেই সঙ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ফলে গ্রামবাংলার সঙ সংস্কৃতি শহরে এসে পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জমিদাররা তাদের প্রচারের জন্য পরোক্ষভাবে ব্যবহার করতেন সঙকে। খেউড়ের জন্যেও একে ওকে বিদ্ধ করে সঙ সৃষ্টি করা হত।
উনবিংশ শতকের কলকাতায় টোল বা পাড়া কালচার ছিল, সেই এক একটি পাড়া থেকে সঙ যাত্রা বের হত। তদানিন্তন সময়ে কলকাতার বসতি গড়ে উঠেছিল জীবিকার ভিত্তিতে। সমজাতীয় পেশার ভিত্তিতে এক একটি পাড়া তৈরি হয়েছিল। যেমন, কুমোরটুলি, বেনিয়াটোলা, আহিরীটোলা ইত্যাদি। কাঁসা-পিতলের ব্যবসায়ীদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল কাঁসারীপাড়া। শাখার ব্যবসায়ীদের নিয়ে শাখারিপাড়া। কাঁসারিপাড়া, বেনেপুকুর, খিদিরপুর, জেলেপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলের সঙ ছিল বিখ্যাত৷ বিশেষ করে জেলেপাড়ার সঙের খ্যাতি ছিল সারা বাংলাজুড়ে৷ ১৮৮২ সালে শুরু হওয়া ওই সঙ বিংশ শতক অবধি চলেছে৷ আবার বন্ধও হয়েছে বার বার৷ প্রধানত উচ্চবর্ণের শোষণ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, প্রশাসনিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণেই জেলেপাড়ার সঙ বারবার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে৷ জেলেপড়ার সঙের গান লিখেছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী, রসরাজ অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রমুখরা৷
কাঁসারীপাড়া পাড়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তারকনাথ প্রামাণিক। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন তারকনাথ প্রমাণিক ও হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের পরিচালনায় কাঁসারীপাড়ার সঙ বেরোতো। সঙ যাত্রার গান, অভিনয়ে, ছড়াতে ব্যবহৃত কিছু শব্দকে অশ্লীল বলে দাগিয়ে দিয়েছিল কলকাতার তথাকথিত ভদ্র সমাজ। পক্ষে, বিপক্ষে বিতর্ক হয়। সঙ যাত্রার উপর বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
সত্যি বলতে, কলকাতার সঙ যাত্রায় নিছকই হাস্যরস ছিল না। জেলেপাড়ার সঙের ছড়া, গান, অভিনয়ে সমাজের দুর্নীতিকে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক আক্রমণ করা হয়েছে, সেগুলি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। জেলে বা কৈবর্তদের পেশা ছিল মাছ ধরা। মধ্য কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলে তারা থাকত। এলাকাটি জেলেপাড়া নামে পরিচিতি। ১৮৮২ সাল নাগাদ দুর্গাচরণ কুণ্ডুর আর্থিক সহায়তায় ও উদ্যোগে শুরু হয় জেলে-কৈবর্তদের সঙের মিছিল, যা সে সময় গোটা উত্তর ও মধ্য কলকাতা ঘুরত। বারান্দা থেকে বাবুরা সঙ দেখতেন, বাড়িগুলোতে ভিড় জমত। ছাদে চাঁদোয়া টাঙানো হত। মহিলারা সেখানে বসে দেখতেন। বাচ্চাদের জন্য দুধ ও অন্যদের জন্য শরবতের ব্যবস্থা থাকত। বৌবাজারের অক্রূর দত্ত লেন, রমানাথ কবিরাজ লেন, শশীভূষণ দে স্ট্রিটের পুরনো বাড়িগুলো আজও সঙ সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করছে। রূপচাঁদ ছাড়াও নাট্যকার ও অভিনেতা গোপাল উড়ে, গুরুদাস দাস, নেপালচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকে জেলেপাড়ার জন্য ছড়া-গান লিখতে শুরু করেন। কলকাতায় প্লেগ মহামারীর আকার নিলে বন্ধ হয়ে যায় এই সঙ যাত্রা। আবার দাঙ্গার বছরেও এই সঙ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ফের জেলেপাড়ার সঙ সংগঠিত রূপে শুরু হয়।
জ্যোতিষচন্দ্র বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেন জেলেপাড়ার সঙ সংগঠন সমিতি, সভাপতি হন ফকির চন্দ্র গড়াই, সম্পাদনার দায়িত্ব নেন জ্যোতিষচন্দ্রের বাবা গোষ্ঠবিহারী বিশ্বাস। অন্যদিকে, ১৮৭৬ সালের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের গেরোয় কাঁসারীপাড়ার সঙ যাত্রা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদী অস্ত্র হয়েই ফিরে আসে জেলেপাড়ার সঙ। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দিতে নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের আহ্বানে অমৃতলাল বসু, দাদা ঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, সজনীকান্ত দাস, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বরা জেলেপাড়ার জন্য ছড়া-গান লিখতে আরম্ভ করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে ব্যবহৃত হতে থাকে সঙ সংস্কৃতি। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকে জেলেপাড়ার সঙ। সঙ ছিল সমাজের দর্পণ।
কয়েকটি সঙের উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চুরি হল। জেলেপাড়ায় সঙ বেরোলো।
'বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে;
সখী নেকী নাকি পড়ল ফাঁকি
কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে।।
বিদ্যা সর্ব্ববিদ্যা অধিকারী
দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী,
নইলে নারী হয়ে জয়ের জারি,
বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে,
থাকে উপোসে,
চন্দ্রমোহন বদনখানি
ঘোমটা দিয়ে ঢাকেন রানী,
নিলেন বাইশ বুরুল
গুণসিন্ধুযুত নব যুব রায় এই শহরে
এখন ধূমকেতু তার ভাগ্যকাশে
মশান ভাসে নয়ন ঝোরে।।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী এবং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে সঙ বেরোয়নি, কারণ হল দাঙ্গা। জেলেপাড়ার সঙে কলকাতার দাঙ্গার কথাও উঠে এসেছে। সে'কথা পরের বছর সঙে উল্লেখ করা হয়।
বিগত বত্রিশ সন
পাননি সঙের দর্শন
তার কারণ পুলিশ বারণ
ক্ষমা ভিক্ষা করছি নিবেদন।
জেলেপাড়ার সঙের জন্য কলম ধরেছিলেন দাদা ঠাকুর।
'উঠব মোরা উঠব,
মোর বিধি আদেশবাণী।'
জেলেপাড়ার সঙ নিয়ে চটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল।
ক্রমেই সঙ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, চটুল রঙ্গরস এবং মনোরঞ্জনের খোরাক কমায় আম জনতা মুখ ফেরাতে শুরু করে। ১৯৩০-৩১ নাগাদ আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণ দেখিয়ে সঙ গঠনটিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ৮০-র দশকে কলিকাতা কৈবর্ত সমিতি ফের নতুনভাবে জেলেপাড়ার সঙকে উপস্থাপিত করে। দাঙ্গা লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন মানুষজন, প্রোমোটার রাজ নিয়েও সঙ বাঁধা হয়। ১৯৯৩ সালে ডঃ প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের উদ্যোগে আবার শুরু হয় জেলেপাড়ার সঙ সমিতি সঙ্ঘ, মিছিল বের করেন শঙ্কর প্রসাদ দে। কিন্তু তাও দাঁড়াতে পারেনি সঙ।
কলকাতার রেলগাড়ি নিয়ে হাওড়া শিবপুরে সঙ তৈরি হয়েছিল, 'কলের গাড়ি বানিয়েছে সাহেব কোম্পানী।
হাওড়া -শিয়ালদহে রেলের আমদানী।
কত শত লোক নিয়েছে গার্ড -ড্রাইভার।
কলিকাতার দপ্তর বিদেশি কারবার।'
আহেরিটোলার সঙ - 'পুজো-পার্বন সারাবছর সব দেখি কলকাতা।
তার ওপর গোলদারের ঘন্টা নেড়ে হলখাতা।'
হাওড়া ব্রিজ নিয়েও সে পাড়ায় সঙ বেরিয়েছিল-
'গঙ্গার জলে নৌকা ভাসে, তার ওপর লোহার খুঁটি।
কলিকাতার বড় সাঁকো, গাড়ি ঘোড়া করে ছুটাছুটি।।'
কাঁসারিপাড়ার সঙ -
'আজব শহর কলকেতা।
আজব শহর কলকেতা।
হেথা ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে,
বলিহারি সভ্যতা।'