সুকুমার-সত্যজিৎ: বাবা-ছেলের সম্পর্কের বুনিয়াদ হয়ে উঠেছিল হ য ব র ল

আজ বাবাদের দিন। জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বাবা, তার অর্থ ঠিক করে বুঝে ওঠার আগেই অনেকে বাবাকে হারিয়ে ফেলেন, তেমনই ছিলেন সত্যজিৎ রায়। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। সত্যজিতের জন্মের পরই অসুখে পড়েন সুকুমার। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। বাবার সঙ্গে চেঞ্জে যাওয়া দুটো সফর আর বাবার লেখা ও আঁকা, সত্যজিৎকে চিনিয়েছিল তাঁর পিতা সম্পর্কে। সোদপুরে গোবিন্দ হোমে বসে গঙ্গায় স্টিমার যাওয়া দেখেছিলেন পিতা-পুত্র। 

সুকুমার এক বিস্ময়ী মানুষ। যা কিছু আপাতভাবে উদ্ভট, আজগুবি তা দিয়েই তিনি নিজের ক্ষণিকের জীবনে বিস্ময় সৃষ্টি করে গিয়েছেন। ছোটদের জন্য রায়চৌধুরীদের অবদান অনস্বীকার্য। সুকুমারও পরিবারের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। খুব অল্প বয়সেই সত্যজিৎ তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন, কিন্তু সুকুমারের সৃষ্টি সত্যজিৎকে তাঁর বাবা পরশের অনুভূতি জুগিয়েছে। হ য ব র ল-ই স্বর্গত বাবার সঙ্গে সত্যজিতের একাধিকার মিলন ঘটিয়েছে। ছাত্রাবস্থায় শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন কলাভবন থেকে ১৯৪২-এ কাকেশ্বরকে নিয়ে নাটক নামিয়েছিলেন সত্যিজিৎ, ১৯৭১-এ আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকীতে হিজিবিজবিজেকে নিয়ে এক কল্পবিজ্ঞানাশ্রয়ী কাহিনী লিখেছিলেন। ১৯৮১ সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ বানালেন একটি তথ্যচিত্র, নাম সুকুমার। এখানেও চলে এল হ য ব র ল। সিলুয়েটে কাগজ কেটে সত্যজিৎ বানালেন গাছ আর তার উপরে কাক্কেশ্বর কুচকুচে। এইভাবেই বাবা-ছেলের মাঝে সেতু হয়ে বারবার, হ য ব র ল এসেছে।

ফেলু কাহিনি নিয়ে বানানো ছবিতেও এসেছেন সুকুমার। মাধ্যম সেই হ য ব র ল! সোনার কেল্লা, মুকুলকে নিয়ে গুপ্তধনের উদ্দেশ্যে ঘুরছে নকল ডাক্তার হাজরা, আর মন্দার বোস। তাদের ধরতে বালি আর কেল্লার শহরে হানা দিল ফেলু আর তোপসে।জটায়ুর সঙ্গে সেই গল্পেই প্রথম দেখা। ট্রেনে বসতে না বসতেই, সেই বিখ্যাত দৃশ্য। উল্টো দিকে সৌমিত্র। প্রাথমিক আলাপ পর্ব শেষ। জটায়ু ফেলুদার শরীরের মাপ জানচ্ছেন। জটায়ুর গল্পের হিরো প্রখর রুদ্রের সঙ্গে ফেলুদার দেহের গঠন মিলবে কিনা তার হদিশ করতেই; প্রখর রুদ্রের শরীরের মাপ বলতে শুরু করলেন জটায়ু, 'উচ্চতায় ছ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। ছাতি ছেচল্লিশ ইঞ্চি কোমর বত্রিশ, কাঁধ বাইশ, কব্জি সাড়ে আট'। গড়গড় করে বলেই জটায়ু ফেলুদাকে জিগ্যেস করেন, 'মিলছে?' 

ফেলুদা সৌমিত্রর উত্তর, 'না'। 

খানিক হতাশ হয়ে জটায়ু জানতে চান, 'আপনার ছাতি কত?', 'ছাব্বিশ ইঞ্চি'। জটায়ু আবার জানতে চান, 'কোমর?' ফেলুদা বললেন, 'ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি।' এবারে হাসতে হাসতে জটায়ু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলেন, 'আপনি কি শুয়োর?' এই অসাধারণ দৃশ্যটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কাল্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আদপে এ তো সুকুমারের লেখা হ-য-ব-র-ল-এর অংশ।

হ-য-ব-র-ল-র সেই দেড়-হাত-লম্বা সবুজ দাড়িওয়ালা বুড়ো উধোর তার পকেট থেকে একটা পুরোনো দর্জির ফিতে বের করে তা দিয়ে মাপ নিতে নিতে কাক্কেশ্বর কুচকুচেকে লিখতে বলেছিল। মনে পড়ে? উধো বলেন, 'খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি।' সেই হিসেব শুনে উত্তর এসেছিল, 'এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি শুয়োর?' ফেলু কাহিনীতে সুকুমারের ছাপ পেলেন পাঠক-দর্শক কূল। সোনার কেল্লার এ সংলাপেই হয়ত সুকুমারের প্রতি সত্যজিতের শ্রদ্ধা ছিল।

এরপরের ছবি জয় বাবা ফেলুনাথ। গণেশ মূর্তি উদ্ধার করতে হবে। কাশীর কানা গলিতে গভীর রাত, ভ্যাম্পায়ারের শঙ্কায় বুক কাঁপছে জটায়ুর। রাতের বেনারসের রাস্তায় পান কিনে ফিরছেন ফেলু অ্যান্ড কো! বেনারসের গলিতে রাত্রে হাঁটতে হাঁটতে ফেলুদা সৌমিত্র প্রথমে বলে ওঠেন, 'অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুমকাম'। বরাবরের ভীতু জটায়ু বলেন, চারপাশ এত নিস্তব্ধ যে একটু ধুমধাম হলে মন্দ হত না মশাই। জটায়ুর কথায় গলির প্রতিটি বাড়িই হন্টেড, ফলে এখান-ওখান থেকে দু-একটা বাদুড় বেরিয়ে এলেও তিনি আশ্চর্য হব না! জটায়ুর মুখ দিয়ে বাদুড় শুনিয়েই, ফেলুদা সৌমিত্রকে দিয়ে হ য ব র ল বলালেন মানিক বাবু। কাশীর গলিতে কানা রাতে সৌমিত্র বলছেন, 'বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু, আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু, আজকে হেথায় চামচিকে আর প্যাঁচারা, আসবে সবাই মরবে ইঁদুর বেচারা।' এ তো সুকুমার! চমকে ওঠেন সুকুমারের পাঠকেরা।

এরপরই ছড়া আর গল্প মিলে যায়। ঘোষালবাড়ির মৃৎশিল্পী নিরীহ নির্দোষ ক্ষীণকায় শশীবাবু মগনলাল মেঘরাজের ভাড়াটে খুনির ছুরির আঘাতে নিহত হলেন। ইঁদুর বেচারা মরল। ছোটদের ছড়ায় মিশে গেল খুন রহস্য!

আবার এই ছবিতেই, গণেশ চুরির রহস্যের কিনারা করতে নাজেহাল ফেলুদা অর্থাৎ সৌমিত্র। মগজাস্ত্রে শান দিতে দিতে আপন মনে সৌমিত্র বলে উঠলেন, 'তিনটে ব্যাপারে খটকা লাগছে, আফ্রিকার রাজা, শশীবাবুর সিং আর আখতারির গান!' স্বভাবসিদ্ধভঙ্গিতে জটায়ুর প্রতিক্রিয়া, 'বোঝো, চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা!' এটাও তো হ য ব র ল। এটাই তো সেই বেড়াল বলেছিল, 'হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে- চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা-- হল চশমা! কেমন হল তো?'

এইভাবেই হয়ত পিতাপুত্রের মেলবন্ধন হয়েছিল।

পরশপাথর ছবিটিও পিতাপুত্রের মেলবন্ধনের সাক্ষী। সত্যজিৎ তাঁর বাবার ননসেন্স রাইমকে তুলসী চক্রবর্তীর সংলাপে দিয়েছিলেন। মনে নেই?

"হলদে সবুজ ওরাং ওটাং

ইট পাটকেল চিৎপটাং

ধর্মতলা কর্মখালি মুস্কিল আসান উড়েমালী।"

ভাবতে অবাক লাগ কীভাবে দুই জিনিয়াসের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পিতা-পুত্রর বন্ধন, রসায়ন তৈরি হয়েছিল!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...