আজ রসগোল্লা দিবস। বিশ্ব জগতের সম্মুখে বাঙালির সেরা আবিষ্কার হল খাঁটি ছানার মিষ্টিটি।রসগোল্লার বার্থ সার্টিফিকেট প্লেস অফ বার্থ হিসাবে লেখা হয়েছে কলকাতার বাগবাজারের নাম কিন্তু এর জন্মস্থান হদিশ পেতে চলে যেতে হয় উনিশ শতকের শেষভাগে। আজ যেখানে বিদ্যাসাগর কলেজের হস্টেল দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানেই ছিল এক পেল্লাই মাঠ। সেই মাঠে পুতুলনাচের আসত। যাত্রাপালা আসত, লাঠিখেলা, শারীরিক কসরত করতে ছেলেপুলেরা আসত। বঙ্গভঙ্গ-স্বদেশী আন্দোলনের সময় মাঠে সভা-সমিতিও হত। শিবাজি উৎসব উপলক্ষ্যে স্বদেশি মেলা বসত। এখন সে মাঠ আর খুঁজে পাওয়া যাবে। মাঠটি পান্তীর মাঠ নামে পরিচিত ছিল।
মাঠটির মালিক ছিলেন রানাঘাটের জমিদার কৃষ্ণকান্তি পালচৌধুরীরা। লোকে কৃষ্ণকান্তিকে পান্তী বলে ডাকত। বাংলার ১০৬৯ সন, হুগলির খানাকুল থেকে এসে নদীয়া রানাঘাটে বসতি স্থাপন করেন মহেশচন্দ্র পাল। মহেশচন্দ্রর পানের ব্যবসায়ী বড় নাতি কৃষ্ণকান্ত ও তাঁর ভাই শম্ভুকে লোকজন পালের বদলে পান্তী বলে ডাকত। প্রথম জীবনে কৃষ্ণকান্ত পান্তী খুব কষ্ট করেন। হঠাৎ করেই তাঁর কপাল খুলে যায়। বিপুল সম্পত্তি করেন। মহারাজ শিবচন্দ্র তাঁকে চৌধুরী উপাধি দিলেন। রানাঘাট গ্রাম নিলামে কিনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণপান্তী ও শম্ভুপান্তী। ‘পান্তী’দের নাম থেকেই কলকাতার মাঠটির নাম হয় ‘পান্তীর মাঠ’। পান্তীদের রানাঘাটের বাড়ির রথ খুব বিখ্যাত। এ বাড়িতে জগন্নাথ রথে চড়েন না, নারায়ণের রথ বেরোয় তাঁদের। বাংলার খাদ্য ইতিহাসে পান্তীরা অমর হয়ে গিয়েছে, কারণ ১৮৪৬ এবং ১৮৫৬ সালের মধ্যে এ বাড়ির ভিয়েনেই রসগোল্লার জন্ম।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ১৩১৩ সনের কার্যবিবরণীর ১১১ নম্বর পাতাটি অন্তত সে'কথাই বলে। ১৮৪৬-৪৭ সাল নাগাদ নদীয়ার ফুলিয়ার হারাধন ময়রা রসগোল্লা তৈরি করেন। হারাধন ময়রা রানাঘাটের জমিদার পালচৌধুরীদের বাড়িতে অর্থাৎ এই পান্তী বাড়িতে মিষ্টি বানাত। সে বাড়ির বাচ্চা মেয়ে কান্না থামানোর জন্যে হারাধন নয়া এক মিষ্টির জন্ম দেন, সেটিই ছিল রসগোল্লা। তবে এই সব মিষ্টিকে ঠিক রসগোল্লা বলা যায় না। আবার কেউ কেউ বলেন পান্তী বাড়িতে মিঠাই বানানতে যাওয়ার সময় হারাধন নিজের কন্যাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ের কান্না থামাতে ফুটন্ত রসে একদলা ছানা ফেলে তৈরি করেন সাদা গোলাকৃতি এক নরম পাকের মিষ্টি, যা রসগোল্লার আদিপিতা। হারাধন ময়রার সে রসগোল্লা ছিল ডেলা রসগোল্লা, তা নরম নয় শক্ত। যদিও নদিয়ার এই প্রাচীন জনপদে চিনি কল ছিল না।
ডেলা রসগোল্লাকে কৌলীন্য দেয় শান্তিপুর। শান্তিপুরের চিনি ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ ইন্দ্র ব্যবসা ছিল কলকাতায়, মিষ্টির দোকান ছিল তাঁর। তাঁর সন্তান কালীদাস ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর অবর্তমানে। কালীদাসের হাত ধরে শান্তিপুরের রসগোল্লা বাগবাজারে আসে। ১৮৬০ সালে কালীদাসের দোকানে নবীনচন্দ্র দাশ কাজ শিখতে গিয়েছিলেন। সেই শিক্ষানবিশই আজকের আধুনিক রসগোল্লা অর্থাৎ স্পঞ্জ রসগোল্লার জনক নবীনচন্দ্র দাস, কমলকুমার মজুমদারের ভাষায় ‘রসগোল্লার কলম্বাস’। তাঁর উত্তরপুরুষেরা রসগোল্লাকে দিলেন পোর্টেবিলিটি। কৃষ্ণচন্দ্র দাস আর সারদাচরণ দাসের নেতৃত্ব রসগোল্লা জগৎজয় করল।
তথ্যঋণ:
রসগোল্লা- হরিপদ ভৌমিক
ক্ষিতিমোহন ঠাকুরের লুচি তরকারি প্রবন্ধ
বাংলার খাবার- প্রণব রায়
নদিয়া কাহিনি- কুমুদনাথ মল্লিক