'জষ্ঠি মাসে আম কাঁঠাল
আষাঢ় মাসে ইলিশ
ভাদ্দর মাসে তালের তত্ত্ব
পুজোয় কুটুম পালিশ'
জন্মাষ্টমী মানেই তাল। বিভূতিভূষণ আর রবি ঠাকুর, গপ্পো আর কবিতা দিয়ে তালকে একেবারে বাঙালির মনে গেঁথে দিয়েছেন। তাল গাছে আবার তেনাদের বাস, এমন একটা বিশ্বাস অনেকেরই আছে। তালকে বোরোলিন, আলু আর রসগোল্লার পর 'চার নম্বর' বঙ্গ জীবনের অঙ্গ মনে হয়। প্রবাদপ্রবচনে তালের ছড়াছড়ি। তাল দিয়ে কত স্থাননাম আছে ভেবে দেখুন, তালদি, তালতলা...। তালের নামে সন্দেশও গড়েছে বাঙালি। তালের জন্য তিথিও রয়েছে বাঙালির, তালনবমী। দুলালচন্দ্র ভড়ের তালমিছরি পেটে পড়েনি এমন বাঙালি মেলা দায়। আমতা হোক বা আমস্টার্ডাম যেখানেই বাঙালি আছে, তার পাকস্থলীতে দুলালের তালমিছরি আছেই আছে। তালের পাটালি বড্ড প্রিয় ছিল, সাদা ধবধবে চাক চাক তাল পাটালির নেশা ধরিয়েছিল দাদু। শীত চলে গিয়ে গরম আসবে আসবে এমন সময় তাল পাটালি উঠত। দাদু আনতো তাল পাটালি, বাবাও আনতো পরের দিকে।
তালপাতা দিয়ে তৈরি হয় হাতপাখা, পাখার বাতাসে পেট না ভরলেও মন ভরে। কারেন্ট গেলে গরম আর মশা জোড়া বিপদকে পরাস্ত করত হাতপাখা। আজকাল কলকাতায় তেমন একটা কারেন্ট যায় না। তবে অন্যত্র লোডশেডিং হয়, মাঝে মধ্যে ফেসবুক পোস্ট দেখি..."জ্যোতি বসু ফিরে এসেছেন", "জ্যোতি বাবু আমাদের এলাকায় দু'ঘন্টা ছিলেন"। মানে দু'ঘন্টা লোডশেডিং ছিল। আজকাল তালপাতার পাখার চাহিদা কমেছে। কারণ, টেকে কম। সে জায়গার দখল নিয়েছে প্লাস্টিকের পাখা, দামে কম মানে ভাল! ঠেকসইও। তালপাতার আরেকটা জিনিসের কথা মনে পড়ে, তালপাতার সেপাই। ব্যাটারি নেই, মেশিন নেই কিন্তু সুন্দর নড়ত-চড়ত। নন্দনে এক ভদ্রলোক বিক্রি করেন, ওঁকে বইমেলাতেও দেখেছি তালপাতার সেপাই বিক্রি করতে।
বাঙালি তিন সময়ে তাল খায়, গরমে খায় তাল শাঁস। তখন তাল কচি থাকে। ভিতরে সাদা শাঁস, তুলতুলে নরম, মিষ্টি। গরমকালে হাটে-বাজারে তালশাঁস কে না খেয়েছে! বর্ষায় খায় তালজাত নানা মিষ্টি। জন্মাষ্টমী তো তালের দিন, কৃষ্ণের বার্থ ডে তাল ছাড়া অসম্পূর্ন, তালের ক্ষীর, তালের বড়া, তালের পীঠে, তালের লুচি, সবতেই তাল। অনেকের বাড়িতে আবার ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যায় তাল খাওয়ার রেওয়াজ আছে। লোকবিশ্বাসে বলে, তাল গোলা থেকে কাঁচা তাল মুখে দিলে দোষ কাটে। তাল থেকে পিঠে তৈরিতে বাঁকুড়ার বেশ সুনাম আছে। গ্রাম-গঞ্জে এখনও আমসত্ত্বর মতো তালসত্ত্ব দেওয়ার রেওয়াজ রীতি আছে।
জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে কাটোয়ায় তালপোয়া নামে নয়া এক মিষ্টির আবির্ভাব হয়েছে গত কয়েক বছরে। তাল ঘষে ময়দা, সুজি দিয়ে বড়া ভেজে চিনির রসে বেশ করে স্নান করিয়ে তুলে নেওয়া হয়। সাইজে তালের ফুলুরির মতো হলেও নাম পোয়া। মালপোয়ার প্রস্তুত পদ্ধতির সঙ্গে এর প্রণালীর মিল আছে বলেই হয়ত এমন নাম হয়েছে। তাল নিয়ে আস্ত একখানা তিথিও আছে, তালনবমী।
আশ্বিনে খাওয়া হয় তাল ফোঁপরা। ভাদ্রে পাকা তালের রস নিংড়ে, ক্বাথ সংগ্রহ করে বানানো হয় বড়া। গড়াগড়ি যাওয়া আঁটি থেকেই ফোঁপরা জন্ম। গ্রাম-গঞ্জে বর্ষাকালে থরে থরে সাজানো বিবর্ণ তালআঁটি দেখা মেলে। আঁটিগুলো মাটিতেই রাখতে হয়। বর্ষায় জল পড়ে আঁটি থেকে অঙ্কুর বের হয়। অঙ্কুর মাটিতে প্রবেশের আগেই তা তুলে নিতে হয়। তারপর আশ্বিন-কার্তিক মাসে তা তুলে ভাঙলে বা কাটলে দেখা যায় ভিতরে তৈরি হয়েছে নারকেলের শাঁসের মতো সাদা বস্তু। ওটাই তালের ফোঁপরা বা তাল ফোঁপর। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় তালের ফোঁপরা দেওয়া হয়। নারকেল ফোঁপরা মতোই কেউ কেউ ফল হিসেবে তাল ফোঁপরা কাঁচা কাঁচা খান আবার অনেকে বেসন-চালের গুঁড়ো-নুন-মিষ্টি মাখিয়ে ভেজেও খান। কোথাও এর নাম তালকলম। কোথাও বা তালকরম। তালআঁটি বলেন কেউ কেউ। এটিই শরৎকালে দেবভোগ্য হয়ে ওঠে।
তাল, এত আপন হলে হবে কী? বাড়িতে তাল গাছকে ঠাঁই দেয় না বাঙালি। বংশ নাশের ভয় বলে কথা!
'তাল তেঁতুল কূল
তিনে বংশ করে নির্মূল'