ফাল্গুনী পূর্ণিমায় দোলোৎসব উদ্যাপিত হয়। কিন্তু পূর্ণিমাতেই কি শেষ হয় যায় দোলোৎসব? বৈচিত্রের বিপুল আধার বাংলায় আরও দোল উদ্যাপিত হয়। তবে সেগুলো শুক্ল পক্ষে নয়, কৃষ্ণ পক্ষে। পঞ্চমীতে পঞ্চম দোল, সপ্তমীতে সপ্তম দোল, অষ্টমীতে অষ্টম দোল, দশমী তিথিতে দশম দোল। আজ রাধাকৃষ্ণর পঞ্চম দোল নিয়ে জানব। কবি গোবিন্দদাসের লেখায় রয়েছে-
খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।
ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ।।
সুন্দরীগণ কর মণ্ডলি মাঝ।
রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।।
আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে।
অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।
বাংলার দোলে রাধাকৃষ্ণর চেয়েও বেশি মাত্রায় রয়েছেন চৈতন্য দেব।
ফাল্গুনপূর্ণিমা তিথি নক্ষত্র ফাল্গুনী।
জনম লভিল গোরা গৌরগুণমণি।।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি হল দোল পূর্ণিমা। পরদিন মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন পালিত হয়৷ তার পরদিন হয় মহাপ্রভুর পাদুকা নিয়ে শোভাযাত্রা ৷ তারপর পঞ্চম ও দশম দিনে হয় মহাপ্রভুর দোল৷ আবার সপ্তম দোলও পালিত হয়। অনেকেই মনে করেন রাধাকৃষ্ণের দোলের দিন মহাপ্রভুর দোল হওয়া উচিত নয়৷ পঞ্চম দোল পালন করা হয়৷ পৌরাণিক ইতিহাস বলে পঞ্চম দোলের সময় শ্রীকৃষ্ণ সখা-সখীদের সঙ্গে দোলায় চেপে আনন্দ করতেন। তাই অনেক জায়গায় দেব মূর্তিকে এই তিথিতে পালকীতে চড়িয়ে ঘোরানো হয়।
নদীয়ার নবদ্বীপে মহা ধূমধামে পালিত হয় পঞ্চম দোল। তবে নবদ্বীপ ছাড়াও মালদহের হরিশচন্দ্রপুর, দুমকার সাদীপুর, বলরামচক, ধানডাঙ্গা, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পঞ্চম দোল আয়োজিত হয়। কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় চট্টরাজবাড়ির পঞ্চম দোল উৎসব খুবই বিখ্যাত। কাটোয়ার পঞ্চম দোলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বর্গী হানার ইতিহাস। ১৭৪২ সাল। সুদে বাংলা চালাচ্ছেন আলীবর্দী খান। আলীবর্দী তখন ওড়িশা অভিযানে, সে সময় মারাঠা দস্যু বর্গী নেতা ভাস্কর পণ্ডিত বাংলা আক্রমণ করেন। বর্ধমান লুঠ করতে করতে তিনি কাটোয়া দখল করে নেন। সে সময় শ্রীখণ্ড থেকে বড়া গ্রামে আশ্রয় নেয় চট্টরাজ পরিবার। বর্গীরা যখন আক্রমণ করে সমস্ত দেবদেবীর মূর্তি ভেঙ্গে দিচ্ছিলেন। সেই সময় মৌগ্রামের পাশে গঙ্গায় বিগ্রহকে বিসর্জন দিয়ে রাধাদামোদর নারায়ণ শিলাকে পৈতায় বেঁধে রাস্তা হাঁটতে শুরু করেন। অনেক রাস্তা পেরিয়ে বড়া গ্রামে তারা বিশ্রাম নেন। সেখানে তিনি স্বপ্নাদেশ পান, গ্রামের উত্তরে নিমগড় পুকুরের কাছে নিমগাছ আছে। সেই নিমগাছের কাঠ থেকে দেবতার দারু বিগ্রহ তৈরি করার নির্দেশ পেলেন তিনি। যে মিস্ত্রি তৈরি করবে সে এই গ্রামেরই পূর্বদিকে বাস করে, স্বপ্নাদেশে তাও জানা হল। বিগ্রহ কেমন হবে তার ছবি শিল্পীর মনের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন বলে জানালেন ভগবান। এরপর নিম গাছের খোঁজ শুরু হয়, সেই গাছ কেটে একটি খণ্ড দিয়ে বিগ্রহ তৈরি হয়। কাটোয়ার মন্দিরের দারু বিগ্রহের উপর সামান্য গঙ্গামাটির প্রলেপ রয়েছে। সনারন্দির রাজার বনহরিবাদের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃষ্ণহরি চট্টরাজ। রাজবাড়িতে দোল উৎসবের কারণে তিনি ব্যাস্ত থাকতেন। তাই সুবিধেমত নিজের বাড়িতে পঞ্চমদোলের প্রচলন করেন তিনি। চৈতন্যমহাপ্রভু অপ্রকট হওয়ার পর লেখা হয় শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, সেখানেও পঞ্চম দোলের উল্লেখ রয়েছে।
কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় চট্টরাজবাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দিরের বয়স প্রায় তিনশো বছর। আজও নাটমন্দির থেকেই বিগ্রহ দর্শন করতে হয়। মহাপ্রভুর মূল মন্দিরে ওঠার অনুমতি নেই সর্বসাধারণের। চট্টরাজবাড়ির দোলযাত্রা দেখতে ভিড় জমান বহু দর্শনার্থী। কারবালাতলার কাছে তিন রাস্তা মোড়ে চাঁচর পোড়ানোর আয়োজন করা হয়। চট্টরাজবাড়ির দোলযাত্রার মূল আকর্ষণ দোলের পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ দোলের দিন নাম সঙ্কীর্তনে, ভোগপুজো ও আরতির আয়োজিত হয়। দুপুরে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়।
বীরভূমের বড়া গ্রামেও মহাধুমধাম করে পঞ্চম দোল হয়। দোলপূর্ণিমার কদিন পর তিথি অনুযায়ী, বীরভূমের নানুর থানার বড়া সাওতা গ্রাম পঞ্ছায়েতের বড়া গ্রামে পঞ্চমীর ভোরে চাঁচর পুড়িয়ে শুরু হয় পঞ্চমদোল। পঞ্চমীতে গ্রাম পরিক্রমায় বের হয় বিগ্রহ, কীর্তন চলে। সন্ধ্যায় কীর্তন ও দোলগান হয়ে রাতে আবির খেলা হয়। ষষ্ঠীর দিন দুপুরে অন্নকূট ও বিকেলে ধূলট হয়ে শেষ হয় উৎসব। পাঁচ রস অর্থাৎ ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষকে ছাড়িয়ে পঞ্চম পুরুষার্থ প্রেমকে স্বীকৃতি দেন মহাপ্রভু, কারণ প্রেমই শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যের আস্বাদন করায়।
ভক্ত ভেদে রতি ভেদ পঞ্চ পরকার।
শাস্ত রতি দাস্য রতি সখ্য রতি আর॥
বাৎসল্য রতি মধুর রতি এ পঞ্চ বিভেদ।
রতিভেদে কৃষ্ণভক্তি রস পঞ্চ ভেদ॥
শান্ত দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর রস নাম।
কৃষ্ণ ভক্তি রস মধ্যে এ পঞ্চ প্রধান ধাম॥”
শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর, প্রেমভক্তির পঞ্চম রস মধুর রসেই পাঁচটি গুণ সম্পূর্ন প্রকাশ পায়। শ্ৰীচৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে, গোদাবরী তীরে রায়রামানন্দের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন মহাপ্রভু। পঞ্চমদোল ছিল এই গ্রামের সবচেয়ে বড় উৎসব। মালদহের হরিশচন্দ্রপুরেও অনন্য পঞ্চম দোল। দেবতারা সবাই নেমে আসেন বাড়ির উঠানে। তারপর রাজসিক দোল। চাঁচলের হরিশচন্দ্রপুরে পঞ্চম দোলযাত্রা মহিমা এমনই। দোলের পাঁচদিন পর অনুষ্ঠিত হয় এই দোল উৎসব। তাই নাম পঞ্চম দোল৷ চাঁচলের হরিশচন্দ্রপুরে জমিদার বাড়িতে হয় অন্যরকম দোলযাত্রা৷ জমিদার বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে রঙয়ের উৎসব মেতে ওঠেন এলাকার মানুষজন। হরিশচন্দ্রপুর জমিদার পরিবারের কুলদেবতা হলেন রাম-কানাই অর্থাৎ কৃষ্ণ এবং বলরাম। সকলে মিলে কুলদেবতাকে রঙ মাখান। নাম-সংকীর্তন চলে। জমিদার বাড়ি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী৷ কুলদেবতাকে পালকিতে করে গোটা গ্রাম পরিক্রমা করানো হয়। পালকিতে গোপাল জিউও চড়েন৷ বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রায় থাকে পুতনা রাক্ষসীর মূর্তি৷ এই বাড়ির দোলের একটি বিশেষত্ব হল এই বাড়ির দোলে কেবলমাত্র লাল রঙের আবিরই ব্যবহার করা হয়। হরিশ্চন্দ্রপুরের শতাব্দী প্রাচীন রায় জমিদার বাড়ির রামকানাইকে ঘিরে পঞ্চম দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘ ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আজ থেকে প্রায় ১৪৬ বছর আগে জমিদার ভজ মোহন রায় এই জমিদারির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন থেকেই দোল উৎসব হয়ে আসছে। আর এই দোল উৎসবে জমিদার বাড়ির সদস্যরা ছাড়াও গ্রামের অন্যান্য মানুষরাও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। পাঁচ দিন ব্যাপী এই উৎসবে কীর্তন চলে, জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল মেলা বসে। পঞ্চম দোলের দিন বিশেষ আতশবাজির প্রদর্শনী হয়।
বীরভূমের হেতমপুর রাজবাড়ির পঞ্চম দলও দীর্ঘদিন করে আয়োজিত হচ্ছে। হেতমপুরের রাজা মারা যাওয়ার পর থেকে এই পঞ্চম দল খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তী উদ্যোগ ফের পঞ্চম দোল শুরু হয়েছে। পুরনো নিয়ম মেনে হরিনাম সংকীর্তন, গীতা পাঠ, পুজো অর্চনা, নবগ্রহের যজ্ঞ, নারায়ণ পুজো দোল খেলা চলে। বীরভূমের দুবরাজপুরের হেতমপুরেই প্রথম পঞ্চম দোল খেলা হয়েছিল হেতমপুর রাজবাড়ীতেই। উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় পঞ্চম দোলের দিন মধ্য ভাটপাড়া অঞ্চলে অমরকৃষ্ণ পাঠশালার কাছে পঞ্চম দোলের মেলা বসে। অতীতের দোল মঞ্চটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাটির বিগ্রহ স্থাপন করে পুজো করা হয়। কাটোয়া ২নংব্লকের সিঙ্গি গ্রামে মঠের বাড়ির পঞ্চম দোল উৎসব পালিত হয়। রাধা-কৃষ্ণ সারা বছর মিশ্র বাড়িতে থাকেন। পঞ্চম দোলের আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় ভট্টাচার্য পরিবার কষ্টিপাথরের রাধা-কৃষ্ণকে বাজনা বাদ্য সহকারে গ্রাম প্রদক্ষিণ করান। তারপর মোরগতলায় ন্যাড়াপোড়া হয়। তারপর মঠের বাড়িতে আনা হয়। পঞ্চম দোলের দিন মঠের বাড়িতে সকালে যজ্ঞ হয়। পুজোর পর বাড়ির মেয়েরা কৃষ্ণকে আবীর মাখিয়ে নিজেরা রঙ খেলায় মাতে। দুপুরে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যাবেলায় আবার মিশ্র বাড়িতে ফিরে যান রাধামাধব।
ভবানীপুরের নন্দন পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী শ্রীশ্রীগোপীনাথ জীউয়ের পঞ্চম দোলযাত্রা। নন্দন পরিবারের গৃহদেবতা গোপীনাথ জীউ এবং শ্রীধর নারায়ন জীউ, রাধারমন জীউকে ঘিরে নিতাই চন্দ্র নন্দনর পরিবারের দোল ও পঞ্চম দোল যাত্রা উৎসব পালিত হয়। নন্দন পরিবারের শাক্ত ও বৈষ্ণব ভাবধারার মেল বন্ধন ঘটেছে। নন্দন পরিবারে দুর্গা, ইচ্ছাময়ী মাতা ও জগদ্ধাত্রী পুজো পান। গোপীনাথ জীউয়ের বয়স আনুমানিক ৩০০বছরের বেশি। তবে শ্রীশ্রীগোপীনাথ জীউ আদপে এই পরিবারের কুলদেবতা নন। ভবানীপুরের লেডিস পার্ক অঞ্চলের স্বর্গীয় শম্ভুচন্দ্র পাত্রর পরিবারের কূলদেবতা ছিলেন গোপীনাথ জীউ। স্বর্গীয় শম্ভুচন্দ্র পাত্রর পুত্র সন্তান না থাকায়, তিনি তাঁর সেজ মেয়ে বন্দনা দেবীর হাতে গোপীনাথ জীউয়ের সেবাভার তুলে দেন। বন্দনা দেবী আর নন্দন পরিবারের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। নন্দন পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার কারণে, তাঁর মাধ্যমে নন্দন পরিবারে এসে পড়েন গোপীনাথ জীউ। গোপীনাথ জীউয়ের বিগ্রহ অষ্টধাতু নির্মিত। শোনা যায়, বহু বার গোপীনাথ জীউ চুরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে চোর চুরি করত সে নিজেই গোপীনাথ জীউকে ফেরত দিয়ে যেত। নতুবা গোপীনাথ জীউ স্বপ্নাদেশে নিজের তাঁর সন্ধান দিয়ে দিতেন। সেই থেকে গোপীনাথকে ঘিরে নানান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। দোলের আগের দিন চাঁচড় পোড়ানো মাধ্যমে দোলযাত্রার সূচনা হয় নন্দন পরিবারে। পরের দিন দোলযাত্রা এবং দোলযাত্রার ঠিক ৫ দিন পর কৃষ্ণা-পঞ্চমী তিথিতে দেবদোল যাত্রার মাধ্যমে গোপীনাথ জীউ পঞ্চম দোল উৎসব পালিত হয় নন্দন পরিবারে।