বারো মাসে বাংলায় নানান ব্রত পালিত হয়। মূলত মহিলারাই সংসারের মঙ্গলের জন্য ব্রত পালন করেন। বাংলায় যে ব্রতগুলি বিপুল জনপ্রিয়, তার মধ্যে অন্যতম হল নীল ষষ্ঠী। সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত পালন করা হয়।
"নীলের ঘরে দিয়ে বাতি
জল খাও গো পু্ত্রবতী।।"
নীল হলেন নীল কণ্ঠ অর্থাৎ শিব। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীল পুজো হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, নীল পুজো হল নীলাবতী ও শিবের বিবাহ অনুষ্ঠান। লোককথা অনুসারে, দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করার পর, তিনি নীলধ্বজ রাজার বিল্লবনে ফিরে আসেন। তখন রাজা তার নাম রাখেন নীলচন্ডিকা বা নীলাবতী। নীলাবতীকে তিনি নিজের কন্যার মতোই লালনপালন করেন। নীলাবতী বিবাহযোগ্যা হলে মহাদেবের সঙ্গে তার বিয়ের আয়োজন করেন রাজা নীলধ্বজ। বাসর ঘরে নীলাবতী শিবকে মোহিত করেন এবং পরে মক্ষিপারূপ ধরে ফুলের সঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নীলাবতী ও শিবের বিবাহ অনুষ্ঠানই হল নীল পুজো। যদিও এই পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও লোককথা অনুসারে অন্য একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। কোনও এক ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর সন্তান জন্ম নিলেও, তাঁদের একটি সন্তানও বেশিদিন বাঁচত না। একের পর এক সন্তানের অকালমৃত্যুর পর শোকে কাতর হয়ে পড়েন তাঁরা। একদিন কাশীধামে গঙ্গার ঘাটে দুজনে বসে শোকের বিলাপ করছিলেন। সেই সময় মা ষষ্ঠী বুড়ি ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশ ধরে সেখানে হাজির হন এবং তাঁদের বিলাপের কারণ জানতে চান। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী তখন বুড়ি ব্রাহ্মণীরূপী মা ষষ্ঠীকে নিজেদের দুঃখের কথা বললে, মা ষষ্ঠী তাঁদের নীল ষষ্ঠীর ব্রত পালন করতে বলেন। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সারাদিন উপবাস করে সন্ধের সময় নীল অর্থাৎ শিবের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে মা ষষ্ঠীকে প্রনাম করে উপবাস ভঙ্গ করতে নির্দেশ দেন। মা ষষ্ঠীর কথামতো ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করেন এবং সন্তান লাভ করেন।
সন্তানের মঙ্গল কামনা এবং দীর্ঘায়ু কামনা নীল পুজোর সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই, এই ব্রতের জনপ্রিয়তা অপরিসীম। নীল পুজো বা নীল ষষ্ঠীর ব্রত গ্রামবাংলার মায়েদের কাছে একটি উৎসব। মা ষষ্ঠী মা দুর্গারই আরেক লৌকিক রূপ। অঞ্চলভেদে এই ব্রত পালনের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে সর্বত্রই মায়েরা নিজেদের সন্তানদের দীর্ঘ জীবন কামনায় এই দিন এই ব্রত পালন করেন।
মায়ের পুজো কয়েকদিন আগে থেকে নিরামিষ আহার করতে আরম্ভ করেন। যদিও এখন তা একদিনের সংযমে এসে ঠেকেছে। এছাড়াও থাকেন নীল সন্ন্যাসীরা, তারা সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করেন। লাল কাপড় পরে, গলায় রুদ্রাক্ষ ও ত্রিশূল হাতে নিয়ে গান গাইতে গাইতে এরা গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করেন। নীল সন্ন্যাসদের গাওয়া গানকে অষ্টক গান বলা হয়। অনেক সময় মানুষকেই শিব দূর্গা সাজানো হয়। নীল ষষ্ঠীর দিন মায়েরা সারাদিন উপবাস করে থাকেন এবং সন্ধ্যায় শিব পুজো করেন। বেলপাতা, ফুল ও যেকোনও একটি ফল শিবলিঙ্গের উপর রেখে সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করেন। কাঁচা দুধ, গঙ্গা জল, মধু, ঘি এবং ডাবের জল ঢালা হয় শিবলিঙ্গে। অপরাজিতা বা আকন্দ ফুলের মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন মায়েরা। শিব মন্দিরগুলিতে ভিড় উপচে পড়ে। ব্রতাচারগুলি আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই ব্রতগুলি পালনের মধ্য দিয়েই সন্তানের জন্য মায়ের নিঃস্বার্থ স্নেহ ভালবাসা ফুটে ওঠে।
নীলের নির্দিষ্ট কোনও মূর্তি হয় না। নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের প্রতিকী মূর্তি বা পাটা তৈরি করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নিচে নামানো হয়। নীল পুজোর আগের দিন অধিবাস হয়। রাতে হাজরা পুজো হয়, অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষ্যে দেবদেবতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। হাজরা পুজোয় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে শ্মশানে গিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। মধ্যরাতে সন্ন্যাসীরা নতুন হাঁড়িতে শ্মশানের কাঠ দিয়ে ভাত রান্না করে। তারপর শোলমাছ পোড়া, ভাত আর ফল মিষ্টি, মদ্য, গঞ্জিকা সহকারে ভোগ নিবেদন করা হয়। পরদিন অর্থাৎ নীল পুজোর সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে ঘোরানো হয়।
নীলসন্ন্যাসীরা শিব-দুর্গার সঙ সাজান, পুজোর সময়ে নীলের পাটাকে সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরানো হয়। ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। এ সময় তাদের মুখে শোনা যায় এক বিশেষ ধরনের গান৷ যা লোকমুখে নীলের গান বলেই পরিচিত৷ এই গানই হল-‘অষ্টক গান’৷ নীল সন্ন্যাসীরা শিব দুর্গার সঙ সেজে বিশেষ নৃত্য করে, যাকে কাছ নাচানী বলা হয়। সন্ন্যাসীরা কয়েকদিন আগে থেকে ব্রত ও সংযম পালন করেন। নীল সন্ন্যাসীরা লাল কাপড় পরে, গায়ে গামছা দিয়ে, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে নীলকে সঙ্গে করে ভিক্ষা করেন। এদের দলপতিরা বালা নামে পরিচিত হয়। ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল এবং কাল্পনিক শিব-দুর্গা থাকেন। গৃহস্থ মহিলারা উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এই সময় গান গাওয়া হয়। গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনী। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন। গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল, সবজি, পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপ দেয়।
গানের কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি,
"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"
"নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"
বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব জানাচ্ছেন,
"ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"
এ প্রসঙ্গে বলি, ষষ্ঠী দেবী লৌকিক দেবী। তিনি মূলত প্রজজনের দেবী, সন্তানদায়িনী ও সন্তানের রক্ষয়িত্রী, মাতৃকা, মঙ্গলদায়িনী প্রকৃত। বাংলার সর্বত্র মা ষষ্ঠী পূজিতা হন। ষষ্ঠী দেবীর পূজা অর্চনা বিধিই ষষ্ঠীব্রত। স্কন্দ পুরাণ অনুসারে দেবী ষষ্ঠী হলেন কার্তিকের স্ত্রী। তিনি ব্রহ্মার মানস কন্যা, নাম দেবসেনা। মাতৃকার মধ্যে প্রধানা, প্রকৃতির ষষ্ঠাংশ রূপা। আবার মতান্তরে দেবী ষষ্ঠী হলেন দূর্গার একটি ভিন্ন রূপ অর্থ্যাৎ কার্তিকের জননী বা কাত্যায়নী। আবার মহাভারতে মগধরাজ বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধের বিবরণে জানা যায় —জরা রাক্ষসীর নামান্তর ব্রহ্মা কতৃক সৃষ্ট। গৃহস্থের গৃহে গৃহে গমন করতেন বলে ব্রহ্মা নাম রাখেন গৃহদেবী। মহাভারতের আদিপর্বে রয়েছে “যে ব্যক্তি যৌবনসম্পনা সপুত্রা মূর্তি গৃহে রাখে, তার গৃহ সর্বদা ধনধান্য, পুত্রকন্যাদিতে পূর্ণ থাকে। তিনিই ষষ্ঠী দেবী। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত, মুকুন্দরাম দাসের কবিকঙ্কণ চণ্ডী ও অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে দেবী ষষ্ঠীর স্বরূপ বর্ণনা রয়েছে। দেবীকে দ্বিভূজা কোথাও বা আবার চতুর্ভূজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর কোলে শিশু সন্তান এবং তিনি বিড়াল বাহিনী। বাংলার অনেক স্থানে ষষ্ঠী দেবীর মূর্তি পুজো করা হয় আবার কোথাও কোথাও মূর্তির বদলে শিলাখন্ডকে ষষ্ঠী রূপে পুজো করা হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী স্বায়ম্ভূব মনুর পুত্র রাজা প্রিয়ব্রত বহু বছর নিঃসন্তান থাকার পর ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ ঋষির সাহায্যে পুত্রষ্টি যজ্ঞ করলেন। কিন্তু রাজমহিষী মৃত পুত্র সন্তানের জন্ম দিলাম। রাজা তাকে নিয়ে শ্মশানে এলে ষষ্ঠী দেবী আবির্ভূতা হলেন এবং মৃত পুত্রকে তপস্যা দ্বারা পুনর্জীবিত করে সঙ্গে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। রাজা তখন দেবীকে স্তব করে তুষ্ট করলেন। দেবী বললেন রাজা স্বয়ং তাঁর পুজোর অনুষ্ঠান করলে এবং সমগ্র রাজ্যে এই তার পুজোর প্রচলন করলে পুত্রকে তিনি প্রত্যার্পণ করবেন। রাজা দেবীর কথায় ষষ্ঠী পুজো করলেন এবং সমগ্র রাজ্যে প্রতি মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী পুজো করা আদেশ দিলেন। এইভাবেই জনসমাজ তথা লোকসমাজে ষষ্ঠী দেবীর ব্রত পালন হয়ে আসছে। বাংলা বারো মাসে বারো রকম ষষ্ঠী উদযাপিত হয়। এছাড়াও শিশুর ছদিন বয়সে ছয় ষষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু নীল ষষ্ঠী হল শিবের আরাধনা। কিন্তু এই ষষ্ঠীরও সূত্রপাত ষষ্ঠী দেবীর মাধ্যমে।
কীভাবে?
ধর্মপ্রাণ এক ব্রাহ্মণ দম্পতির কোনও সন্তান বাঁচত না। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মৃত্যু হয়। তারা দুজনে একদিন তীর্থে বেরিয়ে পড়ল। সরযূ নদীর তীরে এসে ব্রাহ্মণ স্থির করলেন, জলে ডুবেই তারা জীবন শেষ করবেন। তারা নদীতে নামতে লাগল। এমন সময় মা ষষ্ঠী এক বুড়ি মার রূপ ধরে এসে বললেন, ওগো বাছারা, তোমরা আর বেশী দূরে যেও না, আরো দূরে গেলে ডুবে মারা যাবে। তখন বুড়ি মাকে দুঃখের কথা বলল তারা। মা ষষ্ঠী সব শুনে বললেন, দোষ তো তোমাদেরই বাছা, সদ্যোজাত শিশুর কান্না শুনে অহঙ্কারে মত্ত হয়ে তোমরা সবসময়ে আমাকে বলতে, ‘বাবা! আপদ গেলে বাঁচি’। কখনও বলেছ, আহা, ষষ্ঠীর দাস বেঁচে থাক। সেই পাপেই তোমাদের এত দুর্দশা। ব্রাহ্মনী তখন বলল, কে তুমি বল মা। তিনি বললেন, আমিই মা ষষ্ঠী। তিনি নির্দেশ দিলেন চৈত্র মাসে সন্ন্যাস নিয়ে শিব পুজো করার। সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে থেকে নীলাবতীর পুজো করে নীলকন্ঠ মহাদেবের ঘরে বাতি জ্বেলে, তারপর তাঁকে প্রণাম করে জল খেয়ে, নীলষষ্ঠী পালন করতে বললেন। এরপর দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপর ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী নীলের দিন খুব ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে নীলষষ্ঠী ব্রত করল। কিছুদিনের মধ্যেই মা ষষ্ঠীর দয়ায় তাদের পুত্রসন্তান হল। মা ষষ্ঠীর কৃপায় তার কোনও ক্ষতি হল না। সেই থেকে ব্রত পালন আরম্ভ হল।