দার্জিলিঙে যদি নিবেদিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি ফলক দেখেন, চোখে পড়বে কয়েকটি কথা। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের নিবেদিতা, সে তাঁর সব কিছু ভারতের জন্যে উৎসর্গ করেছে। বুদ্ধের যেমন সুজাতা, যীশুর যেমন মেরি ম্যাগডলেন, তেমনই মার্গারেট নোবল হয়ে উঠেছিলেন বিবেকানন্দের নিবেদিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ডাকতেন, লোকমাতা। ঋষি অরবিন্দ নাম দিয়েছিলেন, শিখাময়ী। মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের মানসকন্যা ভগিনী নিবেদিতা আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন, নিজেকে এদেশে সেবায় নিয়োজিত করতে এসেছিলেন, লোকসেবায় নিবেদনের একটি এসেছিলেন, ভারতের হতে এসেছিলেন। ইতিহাসের সমাপতন দেখুন, মার্গারেট যখন মাতৃগর্ভে, তখনই তাঁর মা ইজাবেল প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁর সন্তান নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হলে ঈশ্বরের কাজেই তাকে উৎসর্গ করবেন। সেই মেয়েরই নাম হল নিবেদিতা।
১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর মার্গারেটের জন্ম। ১৮৯৮ সালের ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে নতুন জন্ম দিলেন। স্বামীজি নিবেদিতাকে বেলুড় মঠে দীক্ষা দিয়েছিলেন, নিবেদিতার এক অগ্নিশিখা। স্বামীজি তা বুঝেছিলেন। অন্তরের ঘুমন্ত শিখাই তাঁকে সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে এদেশে এনেছিল, তখন তিনি হয়ে উঠেছিলেন মিস মার্গারেট এলিজবেথ নোবল থেকে নিবেদিতা। ঘুমন্ত শিখায় অগ্নিসংযোগ করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। দহনদানে সম্পূর্ণ নিবেদন করলেন, তাঁর নবজন্ম হল। স্বামীজি তাঁর নাম দিলেন নিবেদিতা। গুরুর ডাকে তিনি হয়ে উঠলেন ভারতসেবিকা। পাশ্চাত্যের জীবন হেলায় ছেড়ে তিনি উত্তর কলকাতার সরু গলি বেছে নিলেন, পীড়িত ভারতবাসীর সেবার দায়িত্ব নিলেন, শিক্ষার দায়িত্ব নিলেন। ১৯০৪ সালে নিবেদিতা লিখেছেন, ‘‘ভিতরে আমার আগুন জ্বলতো, কিন্তু প্রকাশের ভাষা ছিল না। এমন কতদিন হয়েছে কলম হাতে নিয়ে বসেছি অন্তরের দাহকে রূপ দেব বলে— কিন্তু কথা জোটেনি। আর আজ আমার কথা বলে শেষ করতে পারি না। দুনিয়ায় আমি যেন আমার ঠিক জায়গাটি খুঁজে পেয়েছি।... এবার তীর এসে লেগেছে ধনুকের ছিলায়।’’
নিবেদিতা ভারতসেবায় ছুটে বেড়ালেন সর্বত্র। স্বামীজি জাতিকে জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে নিবেদিতা ভারতকল্যাণে ঝাঁপ দিলেন। ধূপের মতো নিজে পুড়ে চারিদিককে সুগন্ধে পরিপূর্ণ করে তুললেন, ভারতের মাটিতে পূর্ণ হল। ১৮৯৫ সালের ১০ নভেম্বর, খুব শীত, রবিবার অপরাহ্নে লেডি ইসাবেল মার্গেসনের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন গোটা পনেরোজন। প্রধানবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ, ততদিনে স্বামীজির বিশ্বজয় হয়ে গিয়েছে। মার্গেসনের বাড়ির ওই দিন অন্যদের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন উইম্বলডনের বাসিন্দা, তরুণী শিক্ষাব্রতী মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। ইসাবেল মার্গেসনের সঙ্গে মার্গারেটের পরিচয় সিসেঁম ক্লাবে। সিসেঁম ক্লাব সেই সময়ের বিশিষ্ট ব্রিটিশদের মিলন স্থল। মার্গারেটের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল অ্যাভেনজার কুক। মার্গারেট রাসকিন স্কুল চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত জীবনে মর্মান্তিক আঘাত পেয়ে আশ্রয়স্থল খুঁজে বেড়াচ্ছেন মার্গারেট। বুদ্ধের জীবনীগ্রন্থ ‘লাইট অফ এশিয়া’ তাঁর হাতে আসে। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা তাঁর কাছে অধরা থেকে যায়। কুকের মনে হয়েছিল মার্গারেট যে আশ্রয় খুঁজে বাড়াচ্ছেন তার সন্ধান হয়ত ভারতীয় সন্ন্যাসীই দিতে পারবেন।
মার্গারেট সেদিন একটু দেরিতে এসেছিলেন। একবারে সামনের খালি চেয়ারে বসলেন। বিবেকানন্দ এসে বসলেন একেবারে মার্গারেটের মুখোমুখি। শুরু করলেন বেদান্ত ব্যাখ্যা, মার্গারেট শুনছেন। প্রথম সাক্ষাৎ সম্পর্কে দ্য মাস্টার অ্যাজ আই সি হিম বইতে নিবেদিতা লিখেছেন, অর্ধবৃত্তাকারে উপবিষ্ট শোতৃমণ্ডলীর দিকে মুখ করিয়া তিনি বসিয়াছিলেন।তাঁহার পশ্চাতে ছিল কক্ষের অগ্নি রাখিবার স্থানে প্রজ্বলিত অগ্নি। আর যখন তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্নের উত্তর দিতেছিলেন, এর মধ্যে মধ্যে উত্তরটি উদাহরণ দ্বারা ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কোন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে সুর করিয়া আবৃত্তি করিতেছিলেন, তখন গোধূলি ও অন্ধকারের মিলন-সম্ভূত সেই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই ভারতের কোন উদ্যানে, অথবা সূর্যাস্তকালের কূপের নিকটে, কিংবা গ্রামের উপকণ্ঠে বৃক্ষতলে উপবিষ্ট সাধু এবং তাহার চারিদিকে সমবেত শোতৃবৃন্দ-এইরূপ এক দৃশ্যেরই কৌতুককর রূপান্তর বলিয়া তাঁহার বোধ হইয়া থাকিবে। ইংলণ্ডে আচার্য হিসাবে স্বামীজিকে আমি আর কখনও এমন সাদাসিধাভাবে দেখি নাই।….সে অপরাহ্নের পর আজ দশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, এবং সেদিনকার কথাবার্তার একটু আধটু মাত্র এখন মনে পড়িতেছে। কিন্তু সেই বিস্ময়কর প্রাচ্য সুর সংযোগ যে সকল সংস্কৃত শ্লোক তিনি আবৃত্তি করিয়া শুনাইয়াছিলেন, তাহা কখনও ভুলিবার নহে; ঐ সুরের ঝঙ্কার আমাদের গীর্জায় প্রচলিত গ্রেগরী-প্রবর্তিত সুরের কথা এত মন করাইয়া দেয়, অথচ উহা হইতে কত ভিন্ন।
এরপর ১৮৯৭-এর ২৯ জুলাই, লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এলেন স্বামীজি। মার্গারেটও ভারতে আসার উদগ্রীব, স্বামীজির কাছে অনুমতি চান। প্রাণ দিয়ে ভারতের সেবা করতে চান তিনি। উত্তরে স্বামীজি জানালেন, ঝাঁপ দেওয়ার আগে ভাল করে ভেবে দেখ। যদি কাজে নামার পর ব্যর্থ হও, বা যদি বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক থেকে অবশ্যই জেনো আমি আমরণ তোমার পাশে থাকব। তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ করো বা নাই করো। মনস্থির করে ফেললেন মার্গারেট, তিনি ভারতে আসবেনই। কবে ডাকেন স্বামীজি, প্রতীক্ষা শুরু হল নিবেদিতার। অবশেষে স্বামীজির চিঠি এল। স্বামীজি মার্গারেটকে লিখছেন, ‘তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতের জন্য, বিশেষতঃ ভারতের নারী সমাজের জন্য, পুরুষদের চেয়ে নারীর-একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ একনও মহিয়সী মহিলার জন্ম দান করতে পারছে না, তা অন্য জাতি থেকে তাকে ধার করতে হবে। তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা-সর্বপোরি তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেলটিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী যাকে আজ প্রয়োজন।’
১৮৯৮ সালের জানুয়ারি মাস মোম্বাসা জাহাজ ভিড়ল। ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসে বিবেকানন্দ তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ভারতবর্ষে মিস নোবলের মতো মহিয়সীর দরকার। জাহাজ জেটিতে আসল। মার্গারেট দেখতে পেলেন বিবেকানন্দকে। গৈরিক বস্ত্র, মাথায় পাগড়ি, পায়ে চটি। ভিড় ঠেলে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার লন্ডনের বন্ধুরা কেমন আছেন? তোমার মা কেমন আছেন মার্গারেট? কেমন চলছে তোমার স্কুল?’ মার্গারেট হাসলেন।
কলকাতায় আসার পর মার্গারেট পার্ক স্ট্রিট-চৌরঙ্গী অঞ্চলে ছিলেন। তারপর চলে আসেন উত্তর কলকাতায়। ১৮৯৮ সালের প্রথম কয়েকটা মাস তাঁর জীবন বড়ই আনন্দে কেটেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রামকৃষ্ণদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে দক্ষিণেশ্বরে এলেন মার্গারেট। তারপর বেলুড়ে পূর্ণচন্দ্র দাঁর বাড়িতে ঠাকুরের জন্মোৎসবে যোগ দিলেন। এই সময় বেলুড়ে মঠ নির্মাণের কাজও চলছে পুরোদমে। সারা বুল আর মিস ম্যাকলাউড বিবেকানন্দের দুই আমেরিকান শিষ্যা ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে এলেন। শিষ্যরা জানতে পারলেন আয়ার্ল্যান্ডের মার্গারেটও এসেছেন ভারতে। মার্চ মাসের গোড়ায় কলকাতার বিশিষ্ট জনেদের সঙ্গে মার্গারেটের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য স্টার থিয়েটারে সভা আয়োজন করা হয়েছিল। সেই স্বামীজি বললেন, ব্রিটেন আমাদের জন্য উপহার পাঠিয়েছে।
১৮৯৮ সালের ১৭ মার্চ তারিখটি মার্গারেটের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ওই দিনই তিনি প্রথম মা সারদা দেবীকে দেখেছিলেন। নিবেদিতা নিজের ডায়রিতে ওইদিনকে এ ডে অফ ডেস বলেছেন। আসলে মা সারদা দেবী সে সময় কলকাতায় ছিলেন না। ১৭ মার্চের দিন কয়েক আগে তিনি জয়রামবাটিতে থেকে ফিরলেন। মা সারদা কলকাতায় আসার পর বিবেকানন্দ ঠিক করলেন মার কাছে তিনি তাঁর তিন বিদেশিনী শিষ্যাকে নিয়ে যাবেন। সেই মতো মায়ের অনুমতিও নেওয়া হল। মা সম্মতি দিলেন। বাগবাজারে মায়ের বাড়ির সামনে সেদিন সাজো সাজো রব। তিন বিদেশিনী এসেছেন জুরিগাড়ি করে। তাদের দেখার জন্য মায়ের বাড়ির গেটে পাড়ার লোকেদের ভিড়। মার্গারেট চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন উৎসাহ ভরে। এ কোথায় এলেন তাঁরা! মা থাকতেন দোতলায়। একে একে তাঁরা তিনজনে উঠে এলেন দোতলার ঘরে। মেঝেতে অতিথিদের বসার জন্য মাদুর পেতে দেওয়া হলো। তারপর ফল আর চা দেওয়া হলো অতিথিদের। মাকেও দেওয়া হল। মা একই সঙ্গে তিন বিদেশিনীর সঙ্গে ফল খেলেন। মার্গারেটের চোখে মুখে খুশির ছোঁয়া। একজন ইংরাজী জানা মেয়ের সাহায্যে মায়ের সঙ্গে আলাপ জমে উঠল। মা প্রত্যেকের পরিবারের খোঁজ খবর নিলেন। আর্শীবাদ করলেন। তিনজনে যখন মায়ের কাছ থেকে উঠে আসছেন, মা মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি আসায় ভারী খুশি হয়েছি মা।’ এবার এল সেই দিন ২৫ মার্চ। দীক্ষা হল মার্গারেটের, নাম দিলেন স্বামীজি। সেদিন থেকে মার্গারেট হলেন নিবেদিতা।