পৌষ মাসের শেষ দিন বা সংক্রান্তিতে সূর্যদেব রাশিচক্রের মকর রাশিতে প্রবেশ করেন। তাই এই সংক্রান্তির আর এক নাম, ‘মকর-সংক্রান্তি’। প্রায় সারা ভারতেই এ-সময় কৃষিপর্বের শেষে ঘরে ঘরে নতুন ফসল তোলার আনন্দ। এ-দিন সেই আনন্দেরই প্রকাশ ঘটে পার্বণের মধ্য দিয়ে।
বাংলায় এ-দিন আমরা নলেনগুড়, নারকেল নাড়ু আর নতুন চালের পিঠেপুলি-পায়েসের আস্বাদে মেতে উঠি, উপভোগ করি ‘পৌষ-পার্বণ’।
বাংলার মতোই বিহার তথা ঝাড়খণ্ড বা উত্তরপ্রদেশেও চালের গুঁড়ো, গুড় ও দুধের তৈরি নানান স্বাদের পিঠে দিয়ে এ-পার্বণ পালিত হয়। সঙ্গে থাকে তিল নাড়ু, তিলকূট। তবে এখানে পার্বণের নাম ‘সাকরাত’ বা ‘খিচড়ি পর্ব’। ‘খিচড়ি পর্ব’, কেননা, পার্বণ উপলক্ষে নতুন চাল, ডাল আর নানারকম সবজি দিয়ে খিচুড়িভোগ বানিয়ে সূর্যদেবকে নিবেদন করার রীতি আছে। এ-পার্বণের আর একটা মজা হল, এ-দিন এখানে স্নানটান সেরে সকাল থেকে ছেলেবুড়ো সকলেই ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দে মেতে ওঠেন।
ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যাপারে এ-দিন গুজরাতবাসীরাও কম যান না। দফায় দফায় তিল নাড়ু, সুরাটি জামুন, উন্ধিয়ুর স্বাদ নিতে নিতে চলে তাঁদের পতঙ্গবাজির খেলা। তবে সেখানে পার্বণের নাম, ‘উত্তরায়ণ’। এ-সময় সূর্যের উত্তরায়ণ গতির সূচনার কথা মাথায় রেখেই তাঁরা আমাদের পরিচিত ‘পৌষ-পার্বণে’র এমন নাম দিয়েছেন।
অন্ধ্রপ্রদেশে এই পার্বণের নাম আবার ‘পেডা পন্দুগা’। এ-দিন বাড়ির মেয়েরা রঙ্গোলি এঁকে, তার মধ্যে ঘুঁটে, হলুদ ও সিঁদুর স্থাপন করে ঘিরে ঘিরে নাচগান করেন। তারপর সেই ঘুঁটে জ্বালিয়ে মঙ্গল কামনা করে একে-অপরকে পিঠে আর মিষ্টি খাইয়ে দেন।
সংক্রান্তির স্নান সেরে কন্নড় মেয়েরা এক খণ্ড আখ, কিছু তিল, নারকেল, বাদাম আর গুড় প্রতিবেশীর বাড়িতে বাড়িতে উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ‘এল্লু বেল্লা থিন্ডু ওল্লে মাথান্ডি’ বলে। এর মানে, ‘তোমরা মুখমিষ্টি করো, তোমাদের মুখে মিষ্টি ঝরুক’। কর্ণাটকে এ-পার্বণকে বলা হয়, ‘সুগগি’।
তবে ঘরোয়া মিষ্টি উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটিতে কন্নড়দের সঙ্গে মারাঠিদের বেশ মিল আছে। মারাঠিরা বলে ‘তিল গুল ঘায়া, গুড গুড বোলা’। এর মানে, ‘তিল নাড়ু খেয়ে মুখ মিষ্টি করো, আর মুখে সব সময় মিষ্টি কথাই বলো’। মহারাষ্ট্রে পার্বণের নাম তাই, ‘তিলগুল’।
তামিলনাড়ুতে এ-পার্বণ পালিত হয় ‘পোঙ্গল’ নামে। এখানে পিঠের সঙ্গে এ-পার্বণে চাল, ডাল, দুধ, কিসমিস, গুড় প্রভৃতি দিয়ে তৈরি ‘পোঙ্গল’ নামের একটি পদ অবশ্যই থাকে। এখানে এ-দিন সূর্যদেবের আরাধনা করা হয়। তবে এখানে এই পার্বণের বিশেষ আকর্ষণ বিদেশি বুল ফাইটের ধাঁচে ষাঁড়ের লড়াই, ‘জালিকাট্টু’।
ষাঁড়ের লড়াই এ-পার্বণ উপলক্ষ্যে আসামেও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পার্বণের নাম ‘ভোগালি বিহু’। এ-সময় স্নানে-নাচে-গানে মুখরিত হন সাধারণ মানুষ। ঘরে ঘরে তৈরি হয় সুঙ্গা পিঠে, তিল পিঠে আর নারকেল নাড়ু।
তবে যেখানে যে-নামেই এ-পার্বণ পালিত হোক না কেন, মূল সুর কিন্তু সেই একটাই, নতুন ফসলের আবাহনে কৃষিজীবনের জয়গান। একে-অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আনন্দযাপন। এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সূর্য আর জলবাহিনী নদীর উপাসনা। কেননা, কৃষিজীবনের সূচনা থেকেই এ নদীমাতৃক সভ্যতায় দুই-ই ছিল আমাদের কৃষির জন্য অপরিহার্য। সূর্যের অয়ন পরিবর্তনে কৃষি-পঞ্জিকার পরিবর্তন ঘটত একদা। আর এই পরিবর্তনকে চিহ্নিত করতেই সূচনা হয় উৎসবের।
তাই এই উৎসব যতটা না পৌরাণিক, তার চেয়ে বেশি লৌকিক। এই পার্বণ নেহাত পৌরাণিক হলে আচারের এত বিভিন্নতা আসত না, শাস্ত্র তাকে নিগড়ে বাঁধত, জনমানসকে এতটা আমূল সম্পৃক্ত করত না। কৃষিভিত্তিক লোকাচার এর আদিম উৎস বলেই সর্বত্র এ পার্বণের অন্তর্লীন উদ্দেশ্য কিন্তু এখনও এক, স্থান ভেদে প্রবাহিত হয়ে চলেছে শুধু আচারের ভিন্নতা...