বিশ শতকের পাঁচ বা ছয়ের দশকের কথা বলছি। সে এক মজার কথা। তখন নলিনীকান্ত সরকার হাসির গান গাইয়ে হিসেবে খুব নাম করেছেন। তাঁকে ঘিরে শ্যামবাজারে পাড়ার ছেলেরা এবং সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস, অমল হোমেরা 'বি কে ক্লাব' নামের একটি ক্লাব গড়ে তুলেছেন। তো, সেই ক্লাবে প্রতিবছর দোল উৎসব হত। সারাদিন পিচকিরির রঙে একে অপরকে চবানো, সন্ধ্যে বেলায় হত আবির খেলা আর বসত গানের আসর।
সেবার দোলের দিন সবাই এসে জুটেছে, কিন্তু নলিনীকান্ত আসেননি। বুড়োকে রঙে না চোবালে কি আর আমোদ জমে! সবাই ছুটলো তাঁর বাড়িতে। এদিকে রঙের ভয়ে নলিনীকান্ত দরজায় খিল দিয়ে চুপটি করে বসে। সাহিত্যিক গোষ্ঠী আর ছেলের দল বন্ধ দরজা দেখে দমাদ্দম কড়া তো নাড়ছেই, সঙ্গে 'নলিনীদা, নলিনীদা' চিৎকারে পাড়া মাতাচ্ছে। নলিনীকান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তবে, বুঝলেন সাড়া না দিলে ব্যাটাচ্ছেলেরা কপাট ভাঙবে। তিনি রসিক মানুষ, অমনি মাথায় গজাল রসিকতার ফিকির। তিনি একখানা কম্বল মুড়ি দিয়ে ম্যালেরিয়া রুগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে গলা পাল্টে মিনমিন করে দরজা একটু ফাঁক করে বললেন, আজ্ঞে, বাবু তো বাড়িতে নেই! কেউ ভাবতেই পারল না কম্বলের তলায় আছেন স্বয়ং নলিনীকান্ত, ভাবল, সত্যিই এ নলিনীকান্তর চাকর। আহা রে, ব্যাটা ম্যালেরিয়ায় ভুগছে! বাড়ির চাকরটাই যদি অসুস্থ হয়...নলিনীদার তো আচ্ছা মুশকিল হল! রঙ দেওয়া মাথায় উঠল, বেচারারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। অভিনয়ের গুণে আর আবেগের চোটে কেউ একবারও ভাবল না যে, তাদের চেনা-জানা একা মানুষ নলিনীদার চাকরবাকর তো কেউ নেই! আর সে কথা ভেবেই একা একা হাসতে থাকেন হাসির গানের গায়ক নলিনীদা।
এবার একটু পিছিয়ে উনিশ শতকে পৌঁছে যাই। কলকাতায় তখন বাবু কালচারের জোয়ার। বাবুদের বাড়িতে দুর্গাপুজো যেমন, তেমনি দোল উৎসবও হয়ে উঠেছিল মাস্ট। রঙ খেলা, বিলিতি মদের ফোয়ারা আর বাঈজি নাচের আসরে কখনো কখনো সাহেবসুবোরাও পায়ের ধুলো দিয়ে ধন্য করতেন। তার মধ্যে এসময় শোভাবাজারের রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেবের বাঈনাচের আড়ম্বর ছিল দেখার মতো।
আর একশো বছর পিছিয়ে আঠেরো শতকের শেষ দিকে চলুন যাই। তখন সবে ইংরেজদের হাতে নগর কলকাতার পত্তন হচ্ছে। তখন আজকের ধর্মতলা ও ডালহৌসি স্কোয়ার-এ বসতি গড়ে উঠছে। এই ডালহৌসি স্কোয়ারেই তখন ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছারি বাড়ি এবং আজকের লাল দিঘির পাড়ে ইষ্টদেবতা শ্যামরায়ের মন্দির। প্রতিবছর এখানে খুব ঘটা করে শ্যামরায়ের দোল উৎসব হত। উৎসবের সময় লাল আবির ও কুঙ্কুমের রঙে মন্দির লাগোয়া দিঘির জল হয়ে যেত এক্কেবারে লালে লাল। এমনকি সামনে যে ছোট্ট বাজারটি ছিল, তার রাস্তাঘাটও লাল আবিরে রাঙা হয়ে উঠত। এই দোল উৎসবের পরম্পরা থেকেই লোক মুখে ধীরে ধীরে দিঘিটির নাম হয়ে গেল, ‘লাল দিঘি’ এবং বাজারটির নাম হয়ে গেল, ‘লাল বাজার’।
জোব চার্ণক একসময় সাবর্ণদের এই কাছারি বাড়িটি বেশ মোটা টাকায় ভাড়া নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস খুলে বসলেন। তখন শ্যামরায়কে নিয়ে যাওয়া হল কালীঘাটে। কালীঘাটের কালী মন্দির সাবর্ণদেরই অধিকারে। তাই এই মন্দিরের পাশে আর একটি মন্দির তৈরি করা হল। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হল শ্যমরায়কে। আজও তিনি সেখানে পূজিত হন, আজও সেখানে তাঁর দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় সারাবছর কালীঘাটে থাকলেও দোলের সময় শ্যামরায়কে লাল দিঘির মন্দিরে আনা হত ও খুব ধুমধাম করে দোল উৎসব হত। কিন্তু এই ঐতিহ্যে ছেদ পড়ল ১৭০৯ সালে এসে। এসময় ইংরেজদের হাতে দিঘির সংস্কার হল, চারপাশে বাগান বানিয়ে তৈরি হল পার্ক। সেখানে নবাগত ইংরেজ পরিবারগুলোর ভিড় বাড়ল এবং এর চৌহদ্দির মধ্যে ভারতীয়দের ঢোকা মানা হয়ে গেল। সেইসঙ্গে দিঘিটি হয়ে উঠল এই অঞ্চলের ইংরেজদের পানীয় জলের ভাণ্ডার। ফলে জল পরিশুদ্ধ রাখতে এই সময় থেকেই এখানে শ্যামরায়ের দোল খেলতে আসাও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কালের স্রোতে একদিন সেই কাছারি বাড়ি নষ্ট হল, নষ্ট হল মন্দির; রয়ে গেল শুধু লাল দিঘি আর তার ইতিহাস।