জাহাঙ্গীরের প্রিয় মোগলাই পরোটা কীভাবে হয়ে উঠল আম-বাঙালির সেরা খাবার ?

দিল্লির মসনদে তখন আসীন জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭)। একদিন দারুণ হইহই পড়ে গেল মুঘল হেঁশেলে! সেদিন খানা নাকি একেবারেই পছন্দ হয়নি বাদশাহর। পোলাও, কাফতা, কাবাব, মালাই হাজার এক পদের আয়োজন হলেও সে সব দেখে বেজায় চটেছেন তিনি। রোজ রোজ এক খাবার আর ভাল্লাগছে না তাঁর। চাই অন্য কিছু!

জরুরি তলব পড়ল হেড বাবুর্চির। তাকে জানানো হলে দশ দিনের মধ্যে নতুন কিছু পদ আবিষ্কার করে খুশি করতে হবে বাদশাহকে, নাহলে বিপদ নাচছে। রাঁধুনি কিন্তু ভয় পেলেন না। ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। শেষ পর্যন্ত মাংস খেয়ে অরুচিতে ভোগা বাদশাকে খুশি করতে পরোটার ভিতর ভরে দিলেন ডিম। আর তার মধ্যে নানা রকম পুর। অন্য কিছু না, চেনা পরোটাকে বুদ্ধি করে বদলে দিয়েছিলেন তিনি।

নবম দিনে বাদশাহকে পরিবেশন করা হল নতুন আবিষ্কার করা পদ। তখন এই পদের নাম ছিল জাবির-ফালা। চারকোণা এক ডিম-রুটি। ভিতরে কিমার পুর। খেয়ে প্রচন্ড খুশি হলেন বাদশাহ। ফের ডাক পড়ল রাঁধিয়ের। তবে এবার আর শাস্তির জন্য নয়, ইনামের জন্য। রাজকোষ থেকে এল হাজার এক স্বর্ণমুদ্রা। বাদশাহ তুলে দিলেন রাঁধিয়ের হাতে, সেই সঙ্গে জায়গীরের দান। জাহাঙ্গীরের মন জয় করা সেই নতুন খাবারের নাম মোগলাই পরোটা। রাঁধুনিও খাস বাংলার মানুষ। বর্ধমানের আদিল হাফিজ উসমান।

কীভাবে রেঁধে বাদশা জাহাঙ্গীরকে তিনি খুশি করেছিলেন সেই রেসিপি তিনি আজীবন গোপন রেখেছিলেন। এমনকি নিজের পুত্র, পরিবারেরও অজানা। পরবর্তী সময়ে উসমান পরিবারও বছরের পর বছর ধরে রক্ষা করে চলেছে গোপনীয়তা। অনেক পরে জানা যায় এই মোগলাই পদের রহস্য।

মুঘল হেঁশেলের মোগলাই পরোটা ক্রমশ বাঙালি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল ব্রিটিশ পর্ব থেকে। চপ, কাটলেট, রোলের সঙ্গে জুড়ে গেল তার নাম। বিশুদ্ধ বাঙালি ‘ফাস্ট ফুড’।

একটি মত আবার বলে মোগলাই পরোটার জন্ম ঢাকা শহরে। যদিও তার তুলনায় বহুল প্রচলিত আদিল উসমানের কাহিনি।

মোগলাই পরোটা বললেই বাঙালি হাঁটতে শুরু করে ধর্মতলার পথে। তাকে থামতেই ধর্মতলার মোড়ে। অনাদি কেবিনে। অনাদি আর মোগলাই জুড়ে গিয়েছে একে- অপরের সঙ্গে। এমন কোনও মোগলাই ভক্ত নেই যারা ‘অনাদি’র নাম জানে না। নিউমার্কেটে বাজার করে, ময়দানে ম্যাচ দেখে, গ্লোবে সিনেমা দেখে মানুষ সোজা চলে আসত অনাদিতে। হাঁসের ডিমের মোগলাই পরোটা একমাত্র টান। শ্বেত পাথরের টেবিল, কাঁটাচামচের শব্দ আর প্লেটে গরম মোগলাই আর আলুর তরকারি, আলাদা করে প্রেম পড়তেই হত কলকাতা শহরটার।

অনাদি’র প্রাণপুরুষ বলরাম জানা। তাঁর ছিল দুই সন্তান- অনাদি আর আদি। টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে বড় ছেলে অনাদি অকালপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর নামেই রেঁস্তোরার নাম হয় অনাদি কেবিন।

বলরাম জানা পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর মহকুমার মোহনপুরের ধুইপাড়ার মানুষ। বাবা বাইনচরণ ও মা বিমলাসুন্দরী। বালক বলরামের পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল, কিন্তু আর্থিক অনটন বড় বাধা। তাই কিশোর বয়সেই চলে আসেন কলকাতায়।     

জীবন সংগ্রামের পথ ধরে ১৯২৫ সালে তাঁর হাতে জন্ম হয় অনাদি কেবিনের। কষা মাংস আর মোগলাই পরোটা হয়ে ওঠে এখানকার সিগনেচার। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।

শুধুমাত্র ‘অনাদি’ নয় মহানগরীর উত্তর থেকে দক্ষিণে এমন আরও এখন কিছু মোগলাই আস্তানা আছে। তেমনই এক নাম দাস কেবিন।

যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে বাঙালি ঝাঁপ স্বাদ-অভিযানে। তার খাদ্য-অভিধানে যোগ হচ্ছে নিত্য নতুন শব্দ কিন্তু মোগলাই পরোটার সাবেকি স্বাদ তার কাছে চিরনতুন। এ স্বাদ কখনও ‘ব্যাকডেটেড’ হতেই পারে না!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...