সাহেব কার্তিক, কার্তিকের লড়াই নিয়ে কাটোয়ায় জমজমাট কার্তিক পুজো

আজ কার্তিক সংক্রান্তি অর্থাৎ কার্তিক মাসের শেষ দিন। যুগ যুগ ধরে এই সংক্রান্তির দিনেই কার্তিক পুজো করে আসছে বাংলা। কার্তিক পুজো বলতেই কাটোয়ার নাম মনে পড়ে। প্রাচীনকালে এই জনপদের নাম ছিল কণ্টকনগর। তদানিন্তন সময়ে, নদীবাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই শহর। কাটোয়ার গঙ্গা তীরবর্তী এলাকায় ব্যবসার কাজেই ক্রমশ বাবু সম্প্রদায়দের ভিড় বাড়তে থাকে। ব্যবসা করতে আসা বাবু শ্রেণীর বিনোদনের জন্যে গড়ে ওঠে যৌনপল্লী। যৌনকর্মীরা সন্তানের কামনায় শুরু করেন কার্তিকপুজো। কাটোয়ার গঙ্গাপাড়ের প্রাচীন চুনারি পাড়ার যৌনকর্মীদের হাত ধরেই কাটোয়ায় কার্তিকপুজোর চল শুরু। পুজোয় খরচ দিতেন বাবুরা। কার পুজো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ, তা নিয়ে প্রতিযোগিতাও হত। এইভাবেই কার্তিকের লড়াইয়ের জন্ম। বণিক ও বারবনিতাদের সম্মিলিত প্রয়াসেই কাটোয়ায় কার্তিক আরাধনার শুরু। ন্যাংটা কার্তিক বা খোকা কার্তিক, যে শিশু রূপে পূজিত। 
 
ভাগীরথীতে তখন জমিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। লবণের ব্যবসা জমে উঠেছিল। স্টিমারে লবণ, রান্নার মশলা আসতে আরম্ভ হল। কাটোয়া থেকে কাঁসা-পিতলের বাসন ও অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানি হতে শুরু হল। কাটোয়ার একটা ঘাটের নাম হয়ে গিয়েছিল লবণগোলা ঘাট। কাটোয়ার ঘাটে দেশ বিদেশের বিভিন্ন বণিকদের দল, বড় বড় বজরার মালিক ও শ্রমিকরা এসে ভিড় করতে শুরু করল। তাদের জন্যে ভাগীরথী তীরবর্তী বারবনিতাপল্লি গড়ে উঠল। বর্গীদের আক্রমণে কাটোয়া ও কাটোয়ার নিকটবর্তী গ্রামের অসংখ্য ধর্ষিত নারী সম্মিলিতভাবে নিষিদ্ধপল্লি গড়ে তোলে। বারবনিতাদের সন্তানলাভের কামনা এবং স্থানীয় বণিকদের অর্থের প্রাচুর্যদের প্রদর্শনের জন্যই নিষিদ্ধপল্লিতে ন্যাংটো কার্তিকের পুজো শুরু হয়। একাধারে নিষিদ্ধপল্লির বাবুদের আভিজাত্যে প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা ছিল এই পুজো, কোন বাবু বেশি খরচ করে, কোন বাবু শ্রেষ্ঠ তার দ্বৈরথ শুরু হল। ঠাকুরের জন্য আলাদাভাবে বিচিত্র আলোক প্রদর্শন ও শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। এই শোভাযাত্রাই ধীরে ধীরে আভিজাত্যের লড়াইয়ে পরিণত হয়, যা আজকের কার্তিক লড়াই। 
 
আবার কাটোয়ায় দেখা মিলবে 'সাহেব কার্তিক'-এর। ঠাকুরের অবয়ব খ্রিস্টান সাহেবের চেহারায় তৈরি। ১৮০৩ সালে শ্রীরামপুরে হাজির হলেন রেভারেন্ড জন চেম্বারলিন। ১৮০৪ নাগাদ সংসার পাতলেন কাটোয়ায়। কাটোয়ায় দেবরাজ ঘাটের কাছে নবাবি সরাইখানায় থাকতেন চেম্বারলিন। কাটোয়া থেকে গোটা বাংলায় সহজেই যাতায়াত করার সুবিধা।
 
দুই একর জায়গা, দুটো পুকুর এবং একটি আম বাগান কিনে, বাংলো বানালেন, গড়ে উঠল সাহেব বাগান। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে কাটোয়ার সেই বাড়িতে মারা গেলেন জন চেম্বারলিনের স্ত্রী হানা চেম্বারলিন। হানাকে সাহেববাগানেই সমাধিস্থ করলেন সাহেব। জন চেম্বারলিনকে সাহায্য করতে কাটোয়ায় হাজির হন উইলিয়াম কেরির পুত্র কেরি দ্যা জুনিয়র। প্রায় চল্লিশ বছরের বেশি সময় তিনি কাটোয়া শহরে কাটিয়েছিলেন। সাহেববাগানের কাশেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে তার সমাধি রয়েছে। কেরি জুনিয়রের জন্ম ইংল্যান্ডের মোলটোন শহরে ১৮৮৭ সালে। শ্রীরামপুরে আসার পর থেকেই কেরির জীবনে খ্রিস্টধর্মের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করে। ছাপাখানার ওয়ার্ড সাহেবই ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু। ১৮০৩ সালের এপ্রিল মাসে বাবার কাছেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে কেরি দ্যা জুনিয়র মিশনারি জীবন শুরু করেন। 
 
১৮১১ সালে রেভারেন্ড জন চেম্বারলিনকে আগ্রায় বদলি করা হয়। সেই বছরই কাটোয়া মিশনারি স্টেশনের দায়িত্ব পান কেরি দ্য জুনিয়র। তিনি দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা, কেঁদুলির মেলা এবং অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলায় ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে বাংলায় যিশুর কথা শোনাতেন। গ্রামে গ্রামে বিনামূল্যে শ্রীরামপুর প্রেসের ছাপা খ্রিস্টধর্মীয় বই বিলি করতেন। কাটোয়া মিশনারি স্টেশনের উন্নতির জন্যে নীলচাষ, বস্ত্রশিল্পের ব্যবসা এমনকি কফিচাষও শুরু করেছিলেন। তারপর শুরু করলেন সংস্কারের কাজ, কাটোয়ায় সতীদাহ, কুষ্ঠরুগী পুড়িয়ে মারা, গঙ্গায় প্রথম সন্তান বিসর্জন ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলন। অন্তর্জলির উদ্দেশ্যে গঙ্গার পাশে ফেলে রেখে যাওয়া একাধিক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে তিনি তুলে এনে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন। একটি হাসপাতালও খোলেন তিনি, বালিকা বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। কাটোয়ার আশপাশে বিভিন্ন গ্রামে অনেকগুলি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সাহেব।
 
১৮৫২-তে কলকাতা আত্মীয়দের কাছে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেই অসুস্থ অবস্থাতে কাটোয়া চলে যান, কিন্তু তার শরীর আর সারেনি। ১৮৫৩ সালে ৩রা ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় কাটোয়ার বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কেরি দ্যা জুনিয়র। সাহেবকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গোটা কাটোয়া জড়ো হয়েছিল সেদিন। আজও প্রতি বছর সাহেব কার্তিক পুজোর দ্বারা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানায় কাটোয়া। এখন কাটোয়ায় প্রায় তিনশোর বেশি কার্তিক পুজো হয়, ইতিহাসের পথ ধরে এসে একুশ শতকে পৌঁছে কার্তিক পুজো এখন কাটোয়ার লোক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...