শবরদের দেবী এবং বৌদ্ধতন্ত্রেরদেবী 'তারা' ও 'একজটা' মিলেমিশে হিন্দু তান্ত্রিকদের হাতে গড়ে উঠলেন, দেবী কালিকা। তের থেকে চৌদ্দ শতকের মধ্যে পুরাণে তাঁর স্থান হয়ে গেল, এমনকি তন্ত্রের পুথিতেও তাঁর পূজাপদ্ধতি লেখা হয়ে গেল। কিন্তু, তান্ত্রিক শ্রেণির বাইরে, তখনও পূজার প্রসার ঘটল না।
চৈতন্য সমসময়ে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম দেবী কালিকার মাটির মূর্তি নির্মাণ করলেন এবং তিনিই প্রথম সহজ পন্থায় কালীপূজার প্রবর্তক। তিনি ‘তন্ত্রসার’-নামক গ্রন্থ রচনা করে তাতে কালীর নানান রূপের উপাসনা ও পূজাপদ্ধতির কথা তুলে ধরলেন। কিন্তু, তাঁর সময়ে বৈষ্ণব প্রভাবে চৈতন্যদেবের ভাবময় ভক্তি আন্দোলনে বাংলা এতটাই ভেসে গেল যে, শাক্তরা কূল পেলেন না। তার দুশো বছরের মধ্যে বৈষ্ণবদের একটা বড় অংশ যখন বৌদ্ধতান্ত্রিকদের মতো সহজিয়া হয়ে গেলেন, যখন তাঁদের সাধনায় ব্যাপক ব্যভিচার প্রবেশ করল, তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল শক্তিসাধনা ও শাক্ত সম্প্রদায়।
এলো আঠের শতক। এই সময়ই কাশীনাথ নামের এক শাক্তসাধক সার্বজনীন কালীপূজার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। তিনি তাঁর ‘কালীসপর্যা’ গ্রন্থে সর্বসাধারণ কেন কালীর পুজো করছেন না, প্রথম এই ধরণের সওয়াল তুললেন। ফলে, তাই নিয়ে সমাজে বেশ আলোড়ন উঠল।
নবদ্বীপের অধিপতি কৃষ্ণনাগরিক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন ঘোর শাক্ত। কিংবদন্তী অনুসারে, তিনি বঙ্গদেশে শারদীয়া দুর্গা পুজোর প্রসার ঘটিয়েছিলেন। গার্হস্থ্য মতে হৈমন্তী কালী পুজোর প্রসারও ঘটল তাঁরই হাত ধরে। কাশীনাথ যখন সাধারণের মধ্যে কালী পুজোর প্রসার ঘটানোর প্রসঙ্গ তুলে সমাজে শোরগোল ফেললেন; শোনা যায়, সেই সন্ধিক্ষণে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নাকি আদেশ জারি করেছিলেন যে, তাঁর প্রজাদের সবাইকেই দেবী কালীর উপাসনা করতে হবে, যিনি সেটা করবেন না, তাকে চরম শাস্তি পেতে হবে! এই আদেশ জারি করার পর থেকেই মহারাজের তালুকজুড়ে প্রতি বৎসর গড়ে প্রায় দশ হাজার কালী মূর্তির পুজো শুরু হয়ে গেল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রজাদের ওপর যে পুজো জোর করে চাপিয়ে দিলেন, কয়েক বছরের মধ্যে সেই চাপানো পুজোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত হয়ে গেল সমাজের দরবারে। এই সময়ের মধ্যেই দেবী কালিকার মাহাত্ম্য সাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য গৃহীসাধক রামপ্রসাদকে দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র ‘কালিকা মঙ্গল’ লিখিয়ে নিলেন, এটিই বাংলার প্রথম কালীকাহিনি।
এমনি করে পুজোর ধারা চলতে চলতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল পেরিয়ে তাঁর নাতি ঈশানচন্দ্রের আমলে এসে কালী আরাধনার আরও প্রসার যেমন ঘটল, তেমনি তা জাঁকজমক-আড়ম্বরেও হয়ে উঠল পরিপূর্ণ। শোনা যায়, ঈশানচন্দ্রের আমলে দেবীকে নিবেদন করা শুরু হল--কয়েক হাজার মণ নৈবেদ্য, কয়েক হাজার মণ কাপড়, প্রভূত অলঙ্কার এবং অন্যান্য সমস্ত উপচার। ফলে, দেবীপূজার সাথে সাথে জাঁকজমকপ্রসারের সূচনাও হল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকেই।
আঠের শতকেই সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের হাতে বাংলা ভাষায় রচিত হল শ্যামামায়ের সাধন গান, 'শ্যামাসঙ্গীত'। সেই গানের মধ্য দিয়ে তাঁরা যেমন হৃদয়ের ভক্তি-আকুতি উজাড় করে দিলেন, তেমনি গৌরীর মতো কালীর সঙ্গেও মা ও মেয়ের সম্পর্ক তৈরি করে ফেললেন। বাঙালির হৃদয়ে ও সংসারে মা কালিকার আসন তৈরির কৃতিত্ব কিন্তু এঁদেরই। তাঁদের জন্যই দেবী কালিকার পূজা বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যেতে পেরেছে। দেব-দেবীর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, যে-সব দেবদেবী আমাদের প্রাত্যহিক সংসারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঘরের মানুষের মতো হয়ে উঠতে পেরেছেন, তাঁরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের নিত্যপূজনীয় ও পূজনিয়া হয়ে উঠেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শিব, কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, বিষ্ণু, গণেশ, সরস্বতীর মতো দেবদেবীরা। আবার যারা যুক্ত হতে পারেননি, যেমন--ব্রহ্মা, ইন্দ্র, বরুণ, পবন, অগ্নি প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা বৈদিক যুগে জনপ্রিয় থাকলেও একালে এসে তাঁদের জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পারেননি, নিত্যপূজনীয় হয়ে উঠতেও পারেননি। একমাত্র যজ্ঞস্থল ছাড়া অন্যত্র তাঁদের উল্লেখ খুব একটা পাওয়া যায় না। সেখানে অনেক পরবর্তীকালে তন্ত্রসাধনার ধারা থেকে উঠে এসেও দেবী কালী কিন্তু বাঙালির আপন হয়ে উঠেছেন মাতৃরূপিণী হয়ে মাতৃসাধকদের পথ বেয়ে।