কালীকথা: বাংলার কালী আরাধনা; মৃত্যুর দেবী থেকে দয়াময়ী, সিদ্ধেশ্বরী

কালী ভয়ংকরী থেকে মনোবাঞ্ছা পূরণের সিদ্ধেশ্বরী মা হয়ে উঠেছেন। তিনি দয়াময়ী, করুণাময়ী, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, কমলাকান্তদের মা আবার ডাকাত-দস্যুদের আরাধ্যা দেবী। ভারততত্ত্ববিদরা কালীকে অন্ধকার, মৃত্যু ও ধ্বংসের দেবী বলে ভাবেন। কালীকাহিনী কি একটাই সরলরৈখিক? সারা বাংলা এমন একটা পাড়া নেই যেখানে কালীর উপাসনা হয় না। কীভাবে হল এমনটা?
 
কালে কালে কালীই হয়ে উঠলেন শাক্ত আরাধনার মূল আধার। নজরুল লিখেছিলেন, কালী মায়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। আবার স্বামী বিবেকানন্দের নাচুক তাহাতে শ্যামা কবিতায়, চূর্ণ হোক্‌ স্বার্থ, সাধ, মান হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা। শ্মশানবাসিনী হয়ে উঠলেন নানান পরিবারের কূল দেবী। ঘটা করে একের পর এক কালী পীঠ তৈরি হল। মাতৃ আরাধনা সর্বজনীন, বারোয়ারি হয়ে উঠল। মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বে অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর নিদ্রিত পঞ্চপুত্রসহ বহু যোদ্ধাকে রুদ্রাস্ত্র ও খড়্গের আঘাতে হত্যা করেন। ওই সময় পাণ্ডব শিবিরের রক্ষীরা রক্তবদনা রক্তবসনা রক্তমাল্যধারিণী কালরাত্রিরূপা কালীকে দেখতে পেলেন।
 
কালী গান করছেন এবং মানুষ, হাতি, ঘোড়াদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন। রক্ষীরা ইতিপূর্বে প্রতি রাতে কালীকে এবং হত্যায় উন্মত্ত অশ্বত্থামাকে স্বপ্নে দেখতেন। অশ্বত্থামা হলেন শিবের অবতার। মহাভারতের আমল থেকেই কালী রক্তপিপাসু এক দেবী, তিনি মৃত্যুস্বরূপা। যদিও মৃত্যুরূপা কালীর মৃত্যু আদপে মোক্ষ। প্রাচীন কবিরা কালীকে বলাকিনী বলে আখ্যায়িত করেছেন। বলাকিনীর ওড়ার ক্ষমতাই হল মোক্ষের প্রতীক। মৃত্যুভয় বা বন্ধনের কারণ হল রিপু অর্থাৎ জাগতিক আসক্তি, কালী আসক্তি দূর করেন। মৃত্যুভয় মূলাধার চক্রের প্রধান নিরাপত্তাহীনতা। কালী হল সেই মহাবিদ্যা যে নিরাপত্তাহীনতা, অবিদ্যা, আসক্তি দূর করেন।
 
বেদ ও পুরাণে রয়েছে দেবী কালিকার কথা। ঋগবেদে কালী আছেন, নাসদীয় সূক্তের একটি ঋকে কালীপ্রতিমার সঙ্কেত রয়েছে। অথর্ববেদে তিনি দেবী নন, তিনি অগ্নির সপ্ত লেলিহান জিহ্বার অন্যতম। রাত্রিসূক্ত অনুযায়ী, রাত যেমন উষাকে গ্রহণ করে আলোর উদয় ঘটায়, কালীও অশিবকে নাশ করে মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যান। মুণ্ডকোপনিষদ অনুযায়ী, অগ্নির সাত জিহ্বার একটি হল কালী, যে কাল অর্থাৎ সময় নির্ধারণ করতে পারে। অন্যদিকে,  মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে দেবী করালী, মহাপ্রলয় সৃষ্টিকারী। সমগ্র বিশ্বকে তিনি গ্রাস করেন বলে করালবদনা। দেবীর বাহন কোথাও শিবা অর্থাৎ শৃগাল, কোথাও শিব, আবার কখনও শব। হরিবংশ ও বিষ্ণুপুরাণে দেবীর বাহন শৃগাল।
 
কালীর কালো রূপ দেখে শিব নাকি বলেছিলেন, তিনি যখন শিবের শুভ্রকান্তি দেহ আলিঙ্গন করেন, তখন কালীকে কৃষ্ণসর্পের মতো লাগে। কালী ক্রুদ্ধ হয়ে তপস্যায় বসেন, ব্রহ্মার বরে গৌরাঙ্গী হয়ে ওঠেন, তাঁর নাম হয় কৌশিকী। শিব হলেন সময় যার বুকের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন দিগম্বরী কালী, লোকোত্তর সময় শবদেহ। কালীর অম্বর দিক।​​দেবীর হাতে নরমুণ্ড, গলায় মুণ্ডমালার হার, দুই শিশুর শব দুই কর্ণের কুণ্ডল। তিনি রক্তপানকারিণী। পিঙ্গল চক্ষুদ্বয়, ত্রিনয়ন ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক, আলুলায়িত কেশ, মদ-মাংস বাম হাতে, দক্ষিণ হস্তে মানুষের কর্তিত মাথা, দেবী হাসিমুখে নরমাংস খাচ্ছেন, শ্মশানকালীর এই চিত্রই তন্ত্রশাস্ত্রে দেখা যায়।পুজোর রীতিও নানান রকম, দুবরাজপুরের শতাব্দী প্রাচীন শ্মশানকালীকে একদা বিসর্জনের সময় ঝাঁটা দেখিয়ে, গালিগালাজ করে মন্দির থেকে শ্মশানকালীকে বের করা হত। বছরভর মন্দিরের দেখা শোনা করেন বৈষ্ণবরা। রাসেও শাক্ত ও বৈষ্ণবদের এমন মেলবন্ধন হয়েছে।
এই দেবীই দয়াময়ী জননী। অষ্টাদশ শতকের আগে দেবী কালীর কোনও মূর্তি ছিল। নবদ্বীপের তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বঙ্গের কালীর রূপ দিয়েছেন। তার আগে শ্মশানে বা নদীতীরে যন্ত্রে, শিলাখণ্ডে দেবীর পুজো হত। আগমবাগীশের চেষ্টায় দেবী ঘরে উঠে এলেন। স্মার্ত পণ্ডিত কাশীনাথের লেখা গ্রন্থে কালীর পুজো বিধান প্রথম পাওয়া যায়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের গুরু ছিলেন আগমবাগীশ। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় কালী আরাধনার প্রচলন হয়। সাধক রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালী আরাধনা করতেন। উনিশ শতকে বাংলার জমিদারদের জন্যেই বঙ্গের কালী আরাধনা জনপ্রিয় হয়। 
 
তবে আগমবাগীশই বাংলার অধুনা প্রচলিত কালীর রূপদান করেন। আগমবাগীশের কথা উঠল যখন, একটা বিষয় না বললেই নয়। নবদ্বীপ ছাড়াও নদীয়ার শান্তিপুরে পৌনে চারশো বছর ধরে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের কালীপুজো চলছে। কৃষ্ণানন্দের বংশধরদের সঙ্গেই পুজোও চলে এসেছিল নদিয়ার শান্তিপুরে। কৃষ্ণানন্দ প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাকালীর পুজো হয় দীপান্বিতা অমাবস্যায়। কার্তিক মাসের পঞ্চমীতে এই পুজোর শুরু। প্রথা মেনে আজও কৃষ্ণানন্দের বংশধররা নিজহাতে ছোট কালীমূর্তি গড়েন। কোজাগরী পুর্ণিমার পরে পঞ্চমী থেকে একাদশী পর্যন্ত ওই মুর্তিতেই করা হয় পুজো। একাদশী তিথিতে শুরু হয় বড় মূর্তি তৈরির কাজ। এরপর কৃষ্ণানন্দের বংশধরদের হাতে তৈরি খড়ের কালী মূর্তিকে বড় মূর্তির হৃদয়ে স্থাপন করা হয়। অমাবস্যা তিথি আরম্ভ হলেই মূর্তির চোখ আঁকা হয়।
 
শোনা যায়, শাক্ত এবং বৈষ্ণবদের বিবাদ মেটাতে শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের উত্তরপুরুষ মথুরেশ গোস্বামী কৃষ্ণানন্দের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে তাঁর নিজের মেয়ের বিয়ে দেন। এরপর নবদ্বীপের তদানীন্তন বৈষ্ণব এবং শাক্ত সমাজ সার্বভৌমকে একঘরে করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় শান্তিপুরের বড় গোস্বামী পরিবারে জামাই এবং মেয়েকে শান্তিপুরে নিয়ে চলে আসেন মথুরেশ। বড় গোস্বামী বাড়ির কাছেই পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে তিনি কালীপুজোর প্রচলন করেন। এরপর শান্তিপুর বড় গোস্বামী পাড়ায় শুরু হয় কালীপুজো। সেই প্রতিমার নামই আগমেশ্বরী। মনে করা হয়, কৃষ্ণানন্দই বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি এবং দক্ষিণাকালিকার পুজোর প্রবর্তক। কৃষ্ণানন্দের পুজোয় ভোগের বিশেষ রীতি রয়েছে, অড়হর ডালের খিচুড়ি, মোচার ঘণ্ট, এঁচোড়ের ডালনা এবং চালতার টক মাকে নিবেদন করা হয়। পুজোর পরদিন বেহারার কাঁধে চেপে দেবী ফিরে যান।
 
আবার বঙ্গে কালীর সঙ্গে অমর প্রেম কাহিনীও মিশে রয়েছে। বর্ধমান শহরের বিদ্যসুন্দর কালীবাড়ি ঘিরে রয়েছে রাজকন্যা বিদ্যার সঙ্গে তরুণ পুজারি সুন্দরের প্রেমের কাহিনী যা আজ লোকগাঁথায় পরিণত হয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বিদ্যা এবং সুন্দরের প্রাণরক্ষা করেছিলেন দেবী। সে কাহিনীর সূত্রেই দামোদরের তীরবর্তী এই মন্দিরের নাম হয়েছে বিদ্যাসুন্দর কালীবাড়ি।
 
কথিত রয়েছে, প্রতিদিন রাজকন্যা বিদ্যার হাতে গাঁথা মালা নিয়ে জনৈকা মালিনী মাসি কালীমন্দিরে আসতেন। সেই মালা দেখেই মন্দিরের পুজারির মনে প্রেমভাবের উদয় হয়। পুজারি ভেবেছিলেন, এমন সুন্দর মালা যিনি গেঁথেছেন, তিনি নিশ্চয়ই অতি সুন্দরী।
 
বিদ্যা এবং সুন্দরের প্রেম শুরু হয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। সে সময় কালী মন্দির থেকে রাজদরবার পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সে সুরঙ্গপথে নাকি একদিন রাজকন্যা বিদ্যার কাছে চলে যান সুন্দর। শুরু হয় গোপনে প্রেম। কিন্তু রাজার গুপ্তচরেরা তা জেনে ফেলেন। বিদ্যা-সুন্দরের প্রেমের খবর পেয়ে ফাঁদ পাতেন রাজা। ধরা পড়েন প্রেমিক-প্রেমিকা। শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড। যুগলকে কালীমন্দিরে বলি দেওয়ার সময় রক্ষা করে মা। বিদ্যা-সুন্দরকে বলি দেওয়ার সময় জ্ঞান হারান যান কাপালিক। সেই সুযোগে বিদ্যা-সুন্দর সেখান থেকে চলে যান। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। এরপর দেবীর স্বপ্নাদেশে মন্দিরে নরবলির প্রথাও বন্ধ করেন রাজা। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...