পঁচিশে বৈশাখ ও রবি ঠাকুর

আজ বাঙালির প্রাণের ঠাকুর কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। বাঙালি নানানভাবে আজকের দিনটি উদযাপন করে, কিন্তু জীবদ্দশায় কেমন করে কবি পালন করতেন নিজের জন্মতিথি। আজ সেই গল্পই হবে, নিজের জন্মদিনেও কলম ধরতেন কবি, নিজের জন্মদিনে প্রথমবার লিখেছিলেন- 'আজ আমার জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ,পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম, জীবনে এমন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্ব্বাদ করুন।'

২৫ বছর বয়সের আগে পর্যন্ত সেভাবে কখনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। সালটা ছিল ১৮৮৬, ৭ মে বাংলায় ২৫ শে বৈশাখ। প্রথমবার নিজের জন্মদিনে কিছু লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম জন্মদিন পালন করেছিলেন তাঁর ভাগ্নি। সেই থেকেই কবির জন্মদিন পালনের শুরু। এরপর থেকেই মহাসমারহে ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালন হত। ভাগ্নি সল্লির মাধ্যমে ‘রইমা’র জন্মদিন পালনের সেই শুরু। প্রসঙ্গত, সরলা দেবী তাঁর রবিমামাকে ‘রইমা’ বলে ডাকতেন।

রবি ঠাকুরের বোনঝি, সল্লি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। রবীন্দ্রনাথ ২৭ বছরে পা দিয়েছেন। তখন তিনি সস্ত্রীক ৪৯ নং পার্কস্ট্রিটে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ এবং তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে থাকতেন। বিপত্নীক জ্যোতিরিন্দ্রনাথও থাকতেন সেই বাড়িতে। কবির নদিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তখন উল্টোডাঙার কাশিয়াবাগানে থাকেন। ১৮৮৭ সালের মে মাসের সাত তারিখ দিনটি ছিল শনিবার, স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী খুব ভোরে কাশিয়াবাগান থেকে দাদা জ্যোৎস্নানাথকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। বাড়ির বকুল ফুল দিয়ে নিজের হাতে মালা গড়েছিলেন। পথে কিনে নিয়েছিলেন বেল ফুলের মালা ও অন্য ফুল। এছাড়াও মামার জন্য উপহার স্বরূপ ধুতি, চাদর এবং একটি ইংরেজি কবিতার বই, The Poems of Heine।

৪৯ নং পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে ঢুকেই সোজা চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথের ঘরে। ঘুমন্ত রবীন্দ্রনাথকে জাগিয়ে ফুল মালা, ধুতি, চাদর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করলেন। জ্যোৎস্নানাথ রবিমামাকে প্রণাম করে বইটি উপহার দিলেন, এটিই রবীন্দ্রনাথের জীবনে জন্মদিনে পাওয়া প্রথম উপহার হিসেবে গণ্য হয়। এরপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও বেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আশীর্বাদ প্রণাম জানালেন। সারা বাড়িতে ‘‘রবির জন্মদিন” বলে সাড়া পড়ে গেল। এরপর কবির বাকি জীবনে অনেক পঁচিশে বৈশাখ এসেছে। বেশ কয়েক বছর পরিবারের মধ্যেই তাঁর জন্মদিন পালন সীমাবদ্ধ ছিল। ঠাকুরবাড়ির ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে, ভাগ্নিরা উৎসাহিত হয়েই তাঁদের রবিকাকা বা রবিমামার জন্মদিন পালন করতেন।

১৮৯৫ সালে, কবির ৩৫তম জন্মদিনে কথা ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’র পাতায় ইন্দিরাদেবী লিখে গিয়েছিলেন, ‘একটি খাতায় আমাদের প্রিয় ইংরেজ কবিদের বিখ্যাত কবিতাগুলি নকল করে তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম। তাঁর প্রতি আমাদের ভাইবোনের ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন’। কিটস, শেলি, ব্রাউনিং, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ বিখ্যাত ইংরেজ কবিদের ৭২টি কবিতা ইন্দিরা নিজের হাতে লিখে ২৮০ পাতার একটি সুদৃশ্য বাঁধানো খাতা উপহার দিয়েছিলেন রবিকাকে।

কবির ৪২ বছরের জন্মদিন পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে গিয়েছেন। একদিকে জগতজোড়া খ্যাতি আর অন্যদিকে নিকট আত্মীয়দের মৃত্যূশোক, তাঁর পারিবারিক বন্ধন আরও আলগা হয়ে গেল। বিশ্বের দরবারে তখন তিনি ক্রমশই আবির্ভূত হচ্ছেন মহামানব হিসেবে। পঞ্চাশতম জন্মদিনে আশ্রমবাসিরা রবীন্দ্রনাথকে আগে থেকে না জানিয়ে মহাসমারোহে জন্মদিন পালন করলেন। কবি এদিন আপ্লুত হয়েছিলেন। এরপর এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার আনলেন তিনি, তখন তিনি বিশ্বকবি। বিশ্বের আঙিনায় নিজেকে মেলে ধরলেন তিনি। ৭০-এ পদার্পণে কবি লিখেছিলেন, ‘ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখ অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছন্ন তিনি এখন চিত্রকর রূপে প্রকাশমান।’ নির্মলকুমারীকে জন্মদিনের দিন তিনি চিঠিতে লিখছেন, ‘এখানে যে রবীন্দ্রনাথ আছে সে এখানকার উপকরণ নিয়ে নিজেকে একটা সম্পূর্ণতা দিয়েছে। তার সঙ্গে পঁচিশে বৈশাখের রবি ঠাকুরের মিল হবে না। দেশে ফিরে গেলে তবে আমি তাকে ফিরে পাব, সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে।’ এও স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন, ‘ আমার বিশ্বপ্রকৃতি আছে সমুদ্রের ওপারে, মানব-প্রকৃতি আছে এপারে।’

এরপর থেকেই তাঁর জন্মদিন পালন প্রথম জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ শিরোনামে, কলকাতার টাউন হলে সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালিত হল। আয়োজনে ভুল বোঝাবুঝি-মনোমালিন্য দেখা দিল। কবি অমল হোমকে হতাশার কথা জানালেন, ‘অনেক পাপের জন্যই বাংলাদেশে জন্মেছি, তাই আজ সত্তর বছরে পুণ্য অর্জনে লেগে গিয়েছি মহা আড়ম্বরে জন্মোৎসব সম্বর্ধনায়।’

এরপর শান্তিনিকেতনের পালা শুরু, কবির বয়স বাড়ছে। শান্তিনিকেতনে তখন প্রচণ্ড দাবদাহ। গ্রীষ্মাবকাশের ছুটির কারণে পঁচিশে বৈশাখ নাগাদ আশ্রম ফাঁকা থাকে। তাই কবির সম্মতি নিয়েই আশ্রমিকরা ঠিক করেন ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন বর্ষবরণের পর কবির জন্মদিন পালন করা হবে। কবি এই প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করলে, তারপর থেকে নববর্ষের দিনই শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হত।

জীবনের শেষ জন্মদিনে, অর্থাৎ ১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও জন্মদিনের উৎসব হয়েছিল। শেষ সময় রবীন্দ্রনাথের এই জন্মদিন পালন হয়েছিল বিশ্বভারতীতে। শান্তিনিকেতনে সকলের সঙ্গে এইদিনটি পালন করেছিলেন। সেদিনও লিখেছিলেন নিজের উদ্দেশ্যে কবিতা। ​কবি লিখছিলেন মানবের জয়গান, ‘ঐ মহামানব আসে’। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আরও একটি লেখা লেখেন-হে পুরুষোত্তম। সেদিন রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবের ভাষণ ছিল ‘সভ্যতার সংকট’। তারপরের জন্মদিনগুলোতে আর পাওয়া যায়নি রবি ঠাকুরকে, কারণ নশ্বর ঈশ্বরের বিদায় হয়ে গিয়েছে ততদিনে...তাই তাঁর সৃষ্টিতেই এখন তাঁকে স্মরণ করি আমরা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...