সূর্যদেব ও ইন্দ্রদেবতা দুজনে মিলে গিয়ে ব্রতপার্বণের ইতিহাসের একটি বাঁকে এসে গেরস্তের ব্রতিনী নারীদের কাছে দেবীতে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। সেই দেবীর নাম, 'ইতু'। পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার এই যে ইতিহাস, এ বড় অভিনব। পূর্ব ইতিহাস যে নেই তা নয়, সমুদ্র মন্থনের শেষে বিষ্ণু দেবতাদের হিতব্রতে মোহিনী নারী হয়ে দেবতাদের অমৃতদান করে অমরত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মঙ্গল করেছিলেন। অশুভশক্তির প্রতীক অসুরদের বঞ্চনা করে শুভশক্তির প্রতীক দেবতাদের সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর এই নারীরূপ তাই মঙ্গলের প্রতীক। শাস্ত্রীয় দেবতা সূর্য ও ইন্দ্র মিলে গিয়ে লৌকিক দেবী ইতু হয়ে ওঠার পেছনেও এই মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে আছে। কীভাবে আছে, সেটাই আমরা আলোচনা করব।
বৈদিক ও উত্তর-বৈদিক যুগের দেবতা সূর্য এবং ইন্দ্র দুজনেই। সূর্য ছিলেন 'প্রাণ'-এর দেবতা। আর, ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা। কৃষির জন্য এই দুই দেবতারই অনুগ্রহের প্রয়োজন। অনুগ্রহ পেতে সে-কালে তাঁদের আরাধনাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, দ্বাপরে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কৃষ্ণের হাতে গিরিগোবর্ধন-পর্বে ইন্দ্রের অহং নষ্ট হচ্ছে! এর থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, তখন থেকেই উচ্চবিত্তের মধ্যে ইন্দ্রপুজোর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমেছে। অথচ, কৃষকশ্রেণির কাছে কৃষিকামনায় এই দুটি দেবতার পুজো আবশ্যক ছিল। কিন্তু, রাজা পূজা না-করলে প্রজা তো আর প্রকাশ্যে পুজো করতে পারে না। তাই এই দুই দেবতার আরাধনা শুরু হল অন্তঃপুরে। পুজোর ভার নিলেন নারীরা। কালক্রমে তাঁদের হাতেই ইন্দ্র ও সূর্য পুরুষত্ব খুইয়ে হয়ে গেলেন নারী, দেবী 'ইতু'। তাঁরা মুখে মুখে রচনা করলেন এই পুজোর মাহাত্ম্যমূলক ব্রতকথাও-
'অষ্টপালনী মাতা সংসারের সার
জগৎপালনে মাতা যারে অবতার।
খণ্ডিয়া পাপ দারিদ্র্য সকল
সকল বিপদে বন্ধন, হয়ে যায় রসাতল।'
ব্রতকথায় রচিত হল, উমনো-ঝুমনোর কাহিনি। কাহিনির মধ্যে পুকুরের জল শুকিয়ে যাওয়া, দেবকন্যাদের আংটিতে তা জলপূর্ন হওয়া, ইতুর ঘটের জলে রাজপুত্রসহ তাঁর সমস্ত সৈন্যদের তেষ্টা মেটানোর যে রূপক তা ইন্দ্র উপাসনা ও কৃষিক্ষেত্রে বৃষ্টি এবং সুজলা শস্যের সমৃদ্ধির কথাই বলে পক্ষান্তরে। তাই ইতুর ব্রতে ঘটভরা জল এবং সরায় নব অঙ্কুরিত শস্য আবশ্যিক উপকরণ। শীতকালীন শুষ্কতার মাঝে বৃষ্টির আবাহনে ইতুদেবীর আরাধনা শুরু হয়। অঘ্রানের সংক্রান্তি এই দেবীর আবাহন কাল। এই ব্রতের সঙ্গে রবিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সূর্যের সঙ্গে এই ব্রতের আদিম সম্পর্ক। তার স্পষ্ট উল্লেখ মেলে ব্রতকথার শ্লোকে-
'শনিবার সপ্তমীতে নিয়মে থাকিবে।
রবিবার ব্রতের কথা প্রভাতে শুনিবে।।'
সুতরাং, ইতু হলেন ইন্দ্র ও সূর্যের সংযুক্তিতে গড়ে ওঠা এক দেবী, যিনি নিতান্তই লৌকিক, যাঁর হাতে গেরস্ত রমণীরা তুলে দিয়েছেন কৃষি ও সম্পদে সংসারের সমৃদ্ধির ভার। এই দিক থেকে ইতু আসলে দেবী লক্ষ্মীরই একটি রূপ।