(…শেষাংশ)
আমরা জানি ব্রাহ্মীলিপি থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব। এ বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে, বিদ্যাসাগরের হাতেই প্রথম বাংলা বর্ণমালার বাস্তব ও প্রয়োগ-বান্ধব উন্নতি কার্যকর হয়। বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় বইতে বাংলা বর্ণমালাকে এমনভাবে সংস্কার করেন ও সাজান যে, পরবর্তী সার্ধশত বছরে মাত্র কিছু সংস্কারমূলক কাজ করতে হয়েছে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হ্যালহেডের বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর মদনমোহনের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (প্রকাশকাল ১৮৪৯) পর্যন্ত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১৬ই ছিল। এগুলো হল: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋৃ, ৯, ৯৯, এ, ঐ, ও, ঔ, অং, অঃ। বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২তে নামিয়ে আনেন। বিদ্যাসাগরের এই সংস্কারের ১২৫ বছর পর স্বরবর্ণে আর একটি সংস্কার ঘটেছে, তা হল ‘৯’ বর্ণটি বাদ দেওয়া। এখন স্বরবর্ণ ১১টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুনভাবে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেন। অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখলেন, বাঙ্গালা ভাষায় এ-কারের ত, ত্ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে। এটিকেও তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত করেন। ক্ষ যেহেতু ক ও ষ মিলে "সুতরাং এটি যুক্তবর্ণ। এ জন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।" এভাবে তাঁর হাতে ব্যঞ্জনবর্ণ হলো ৪০টি। এরপর ১২৫ বছরে কেবল অন্তস্থ ‘ব’ টি ব্যঞ্জন থেকে বাদ গিয়েছে।
১৫০ বছর আগে লিখিত অথচ বিদ্যাসাগর তাঁর শিশুতোষ রচনায় কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেন নি। কাহিনীর সঙ্গে ধর্মের ও ধর্ম সংস্কারে সংস্রব নেই, জোর দিয়েছেন তিনি নীতিশিক্ষার ওপর, ভালোমন্দ বুঝে সচ্চরিত্র গঠনের ওপর। বইটি পড়লে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষক-শিক্ষণেরও পথিকৃৎ। তিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু পরামর্শও লিখে গেছেন। বর্ণপরিচয়-এর দুটি ভাগেই বর্ণযোজনার নির্দেশিকা দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের ষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি শিক্ষকদের জন্যই লেখেন, ‘প্রায় সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা, অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা সেরূপ না বলিয়া কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বইতে প্রথম শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচিত হয়েছে। প্রথমে শিশুরা বর্ণক্রমিক পদ্ধতিতে বর্ণ শিখবে, বর্ণের সঙ্গে মুখে মুখে ছোট ছোট শব্দ শিখবে, এরপর বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা, তারপর বর্ণযোজনা ও ফলা সংযোগে বানান শেখার সূচনা। এরপর রয়েছে সহজবোধ্য ছোট বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা। যা তৎকালীন বিবেচনায় অত্যন্ত বিজ্ঞানমূলক ছিল। বর্ণপরিচয়ের আগের পুস্তকসমূহে ছিল কঠিন ও অবোধ্য শব্দ। বিদ্যাসাগর পূর্বেকার অবোধ্য ও দুর্বোধ্য শব্দকদম্ব মুখস্থ করার পরিবর্তে শিশু পরিচিত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বাংলা গদ্য রচনার মাধ্যমে শিশু শিক্ষার সূত্রপাত করেন। এভাবে বিদ্যাসাগর শিক্ষিত বাঙালির জন্য সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন।
গ্রন্থটি যে শুধু বিদ্যাসাগরের জীবৎকালেই সমাদৃত হয়েছিল তাই নয়, গ্রন্থপ্রকাশের সার্ধ-শতবর্ষ পরেও এর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো|