এখনকার প্রজন্মের কাছে প্রায় 'অচ্ছুত' হলেও, এই চটি বইটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেকেরই শৈশববেলা। অক্ষর, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, 'পথ ছাড়ো। জল খাও। হাত ধর।'- ছন্দ, যতি, 'সহজপাচ্য' গদ্য -এসবের মাধ্যমে ছোটদের ভবিষ্যৎ গড়নের ভিত্তিপ্রস্তর ছিল সেই চটি বইটিই, যার নাম 'বর্ণপরিচয়'।
'বর্ণপরিচয়' ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রাথমিক বই। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল অর্থাৎ আজকের দিনেই প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়- প্রথম ভাগ এবং একই বছর জুনে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়- দ্বিতীয় ভাগ। প্যারীচরণ সরকার ও ঈশ্বরচন্দ্র একসময় সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁরা ইংরেজি ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বই লিখবেন। সেইমত প্যারীচরণ 'First Book of Reading' এবং বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ প্রকাশ করেন।
জানা যায়, বিদ্যাসাগর মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পালকিতে বসে বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। 'দুই পয়সা' মূল্যের এই চটি বইটির প্রকাশ ছিল বাংলার শিক্ষাজগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই বইতে বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষার অযৌক্তিক শাসন থেকে মুক্ত করে যুক্তি ও প্রায়োগিক বাস্তবতায় বর্ণমালার সংস্কার-সাধনে প্রবৃত্ত হন। শতাধিক বছরধরে শিশুদের প্রথম পাঠ হিসেবে এ বইটি প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এর পাশাপাশি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ এবং আরও পরে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা শিশুদের প্রথম পাঠ্য বই হিসেবে বহূকাল প্রচলিত ছিল।
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পূর্বেও ছাপার অক্ষরে এই জাতীয় কিছু পুস্তিকা বাজারে ছিল। এ প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১), স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩ ?) ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫৪), ক্ষেত্রমোহন দত্তের তিন ভাগে রচিত শিশুসেবধি (১৮৫৪), মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থগুলোর কথা বলা যায়। তবে এই সব পুস্তিকা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি। কারণ বাংলা বর্ণমালায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার বিশেষ কোনও রূপ পুস্তিকাগুলোতে ছিল না।
এপ্রসঙ্গে সুনীতিকুমার লিখেছেন "বাঙ্গালা গদ্য-সার্থক বাঙ্গালা গদ্য-অনেকে লিখিয়াছেন এবং আজও অনেকে লিখিতেছেন। বাঙ্গালা গদ্যের অন্তর্নিহিত ঝংকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এখনকার দিনে অসম্ভব নয়। কিন্তু যখন ভালো গদ্যের নমুনা কদাচিৎ দেখা যাইত, সেইকালে বিদ্যাসাগর যে কী অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে বাঙ্গালা গদ্যের সেই অন্তর্নিহিত ঝংকারের সম্ভাবনা বা অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হয়।---অর্থাৎ গদ্য রচনার ছন্দবিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা; গদ্যপাঠের ধ্বনি-সামঞ্জস্যে যে পাঠক ও শ্রোতা আনন্দ পাইতে পারে, এই সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁহার ছিল।"
ঈশ্বরচন্দ্রের গদ্যের এই গুণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
"গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধ্বনি-সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তাহার গতির মধ্যে একটি অনতি লক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সবল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া, বিদ্যাসাগর বাংলাকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।"
বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষার পটভূমি পর্যালোচনা করলে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত শ্রীমন্তের শিক্ষারম্ভ থেকে ষোড়শ শতকের বাংলায় শিশুর শিক্ষার সূচনাপর্বের একটা চিত্র পাওয়া যায়। পাঁচ বছরের শিশুকে গুরুর পাঠশালায় হাতেখড়ি দেওয়া হত এবং সেখানে এই শিশু শিক্ষার্থী গুরুর কাছে মুখে মুখে এবং হাতে লেখা পুঁথি থেকে ভাষা, নীতি এবং জমিজমা ও ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব- নিকাশ, বাক্য, শ্লোক ইত্যাদি পড়ত, মূলত মুখস্থ করত। মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হওয়ার পর প্রথম একটি বাধা ছিল পাশ্চাত্যের যন্ত্রে মুদ্রিত গ্রন্থপাঠে জাত যাবে-এ রকম কুসংস্কার। অন্যদিকে দেখা যায়, রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১) বইটিতে বর্ণমালা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে ও বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮! যে কারো ক্ষেত্রে-শিশু বা বৃদ্ধ-শিক্ষাজীবন শুরু করার জন্য এ রকম ঢাউস ও গুরুগম্ভীর বই উপযুক্ত ছিল না।
বিদ্যাসাগরের আগে বর্ণমালা শেখার যে সকল বই প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশই শিশুর বাংলা প্রথম পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শ্রীরামপুর মিশনের লিপিধারা (১৮১৫), জ্ঞানারুণোদয় (১৮২০), রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শিশুবোধক, বঙ্গবর্ণমালা (১৮৩৫), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি, বর্ণমালা (১৮৪০), কলিকাতা স্কুল বকু সোসাইটির বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩), ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৪) এবং হ্যালহেডের এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজসহ (১৭৬৮) অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বিদ্যাসাগর-পূর্ববর্তী বাংলাভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ হিসেবে সবার আগে যে গ্রন্থটির নাম করতে হয় সেটি হচ্ছে, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯)। শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য বই।
(ক্রমশঃ)…